আমদানি-রপ্তানি দুটোই কমছে, সংকট বাড়ছে

রপ্তানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে আমদানি।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Jan 2020, 06:24 PM
Updated : 7 Jan 2020, 06:26 PM

চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ৭ দশমিক ৫১ শতাংশ; আর আমদানি খাতে খরচ কমেছে ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ।

অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই দুই সূচক একসঙ্গে কমাকে ভালো চোখে দেখছেন না অর্থনীতির গবেষক এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।তিনি বলছেন, এতে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অর্থনীতিতে সংকট বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে মোট ২ হাজার ২২০ কোটি (১৮.১৩ বিলিয়ন) ডলার ব্যয় করেছে বাংলাদেশ। আর পণ্য রপ্তানি থেকে আয় করেছে এক হাজার ৫৫২ কোটি (১২.৫২ বিলিয়ন) ডলার।

গত অর্থবছরের একই সময়ে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল এক হাজার ৬৭৮ কোটি ডলার। আমদানি খাতে ব্যয় হয়েছিল দুই হাজার ৩৪৩ কোটি ২০ লাখ ডলার।

এ হিসাবেই এই পাঁচ মাসে আমদানি ব্যয় কমেছে ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ; রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ৫১ শতাংশ।

তবে রোববার ছয় মাসের রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করেছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো। তাতে দেখা যায়, টানা চার মাস পর ডিসেম্বরে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে।তারপরও জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ কম আয় দেশে এসেছে।

একাত্তর টেলিভিশন আয়োজিত ‘উন্নয়নশীল বাংলাদেশ: চ্যালেঞ্জসমূহ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

এই তথ্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ২০০৭-০৮ মেয়াদের তত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আপাত দৃষ্টিতে আমদানি ব্যয় কমাকে অর্থনীতির জন্য ভালো বলেই ধরে নেয়া হয়। বিদেশী মুদ্রা খরচ কম হয়। রিজার্ভে চাপ পড়ে না।

“কিন্তু দেখতে হবে কি আমদানি কমছে। উৎপাদন বেশি হওয়ার কারণে খাদ্যপণ্য আমদানি যদি কমে যায় তাহলে খুবই ভালো। দাম কমার কারণে জ্বালানি তেল আমদানিতে খরচ কমলে সেটাও ভালো। তবে ক্যাপিটাল মেশিনারি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি যদি কমে যায় তাহলে উদ্বেগের বিষয়। আর আমাদের এখন সেটিই হয়েছে।”

“ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি বেশ কমেছে। তার মানে, দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। উদ্যোক্তাদের কাছে পর্যাপ্ত ব্যাংকঋণ যাচ্ছে না। অন্যদিকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। এর ফলে শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহৃত হচ্ছে না।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য ঘেটে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে শিল্প  স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমেছে ১০ শতাংশের বেশি। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ২০ শতাংশ। জ্বালানি তেল ১৫ শতাংশ।

বাণিজ্য ঘাটতি ৬.৬৮ বিলিয়ন ডলার

আমদানি-রপ্তানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৬৮ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল এর চেয়ে কিছুটা কম; ৬৬৫ কোটি ২০ লাখ ডলার

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পুরো সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫৪৯ কোটি ৪০ লাখ (১৫.৪৯ বিলিয়ন) ডলার।২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল আরও বেশি ১৮ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।

বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, আমদানি খাতে ব্যয় বাড়ার কারণে রপ্তানি আয় বাড়লেও বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু এবার আমদানি ব্যয় কমার পরও রপ্তানি আয় কমায় বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে।

সেবা খাতের ঘাটতি ১.৩৬ বিলিয়ন ডলার

তবে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমেছে। জুলাই-নভেম্বর সময়ে এ খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৩৬ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল এর চেয়ে একটু বেশি; ১৪৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।

লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ১.১ বিলিয়ন ডলার

জুলাই-নভেম্বর সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৪২ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এই ঘাটতি ছিল ৬৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অথচ অগাস্ট মাস শেষেও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

এই পাঁচ মাসে সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩০ কোটি ৭০ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল আরও বেশি; ৮৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার

তবে আর্থিক হিসাবে (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। জুলাই-নভেম্বর সময়ে এই উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ১২২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে উদ্বৃত্ত ছিল ১০৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

চলতি হিসাবের ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শুরু করেছিল বাংলাদেশ। প্রথম মাস জুলাইয়ে ২৪ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।অগাস্ট শেষে উদ্বৃত্ত দাঁড়ায় ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার। সেপ্টেম্বর থেকে ঘাটতি দেখা দেয়।

চলতি হিসাবের ভারসাম্য ৫২৫ কোটি ৪০ লাখ ডলারের বড় ঘাটতি (ঋণাত্মক) নিয়ে শেষ হয়েছিল গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল আরও বেশি ৯৫৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাব উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হল, নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

এফডিআই বেড়েছে ৪.৪২%

তবে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে।

গত বছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ২১০ কোটি ৮০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশে। এই বছরের একই সময়ে এসেছে ২১৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

এ হিসাবেই চার মাসে এফডিআই বেড়েছে ৪ দশমিক ৪২ শতাংশ।

এই চার মাসে বাংলাদেশে নিট এফডিআই এসেছে ১১২  কোটি ডলার। আগের বছরে একই মাসে এসেছিল ১০৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকেই নিট এফডিআই বলা হয়ে থাকে।

পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগে খরা

তবে পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) প্রবাহের গতি গতবারের মতোই হতাশাজনক।

২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে মাত্র ৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল আরও কম; ৪ কোটি ডলার।

জুলাই-নভেম্বর সময়ে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাবদ বাংলাদেশে এসেছে ১৫৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার। গত বছরের এই পাঁচ মাসে এসেছিল ১৪৪ কোটি ডলার।