তিতাসে সিস্টেম লসের ৭৭০ কোটি টাকার হিসাব নিয়ে প্রশ্ন

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস এক বছরে প্রায় ৭৭০ কোটি টাকা সিস্টেম লসের যে হিসাব দিয়েছে, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।

রিয়াজুল বাশার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Jan 2020, 04:06 PM
Updated : 1 Jan 2020, 06:22 PM

সিস্টেম লস এক বছরে এক লাফে প্রায় পাঁচ গুণ বেড়ে যাওয়া বিষয়ে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য, ‘গ্রহণযোগ্য’ সিস্টেম লস হওয়া উচিৎ ছিল ২৩৮ কোটি টাকা।

ভোক্তা অধিকার রক্ষার সংগঠন ক্যাব-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলছেন, সিস্টেম লস বা পদ্ধতিগত ক্ষতি নিয়ে তিতাসের হিসাবের সঙ্গে কোনোভাবেই একমত হতে পারছেন না তারা।

তবে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিস্টেম লস বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিলের পরিবর্তে প্রকৃত ব্যবহারের হিসাব আওতায় আনা, হাইয়ার হিটিং ভ্যালু, লাইন ফুটো হয়ে গ্যাস বের হয়ে যাওয়া এবং ট্রান্সমিশন লাইন থেকে বিতরণ লাইনে আসার সময় সঠিকভাবে হিসাব না করার বিষয়গুলোকে দেখাচ্ছেন।

দুই বছর আগে আবাসিকে নতুন সংযোগ দেওয়া বন্ধের সময়ও গ্রাহক সংখ্যা এক লাফে ৩৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার তথ্য দিয়ে তিতাস কর্তৃপক্ষ বলেছিল, ম্যানুয়াল পদ্ধতি থেকে ডাটাবেইজে হালনাগাদের কারণে এই সংখ্যা বেড়ে যায়।

তখনও তিতাসের সেই যুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল।

নানা অভিযোগ পেয়ে তদন্ত চালিয়ে তিতাসে দুর্নীতি ও অনিয়মের ২২টি উৎস চিহ্নিত করার কথা সম্প্রতি জানায় দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক।

গত ২২ ডিসেম্বর তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় ২০১৮-১৯ বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করা হয়।

প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, গত পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিস্টেম লস হয়েছে ২০১৮-১৯ বছরে। এবছর সিস্টেম লসে পড়েছে ১০০৩ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস, যা তিতাসের কেনা মোট গ্যাসের ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ। এই গ্যাসের মূল্য ৭৬৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।

অথচ এর আগের অর্থবছর (২০১৭-১৮) সিস্টেম লস ছিল মোট কেনা গ্যাসের ১ দশমিক ১৭ শতাংশ বা ২০১ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ঘনমিটার, ২০১৬-১৭ বছরে ছিল ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ বা ২৩২ দশমিক ৮৯ মিলিয়ন ঘনমিটার, ২০১৫-১৬ বছরে ২ দশমিক ৮১ শতাংশ বা ৪৭৯ দশমিক ২২ মিলিয়ন ঘনমিটার এবং ২০১৪-১৫ বছরে সিস্টেম লস ছিল ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ বা ৬২৫ দশমিক ৬২ মিলিয়ন ঘনমিটার।

২০১৪-২০১৫ অর্থবছর থেকে পরপর চার বছর ক্রমাগত কমতে থাকা সিস্টেম লস হঠাৎ করেই গত অর্থ বছরে এক লাফে পাঁচ গুণ বেড়ে গেছে।

তিতাস গ্যাসের দেওয়া সিস্টেম লসের হিসাব

সিস্টেম লস বেড়ে যাওয়ার ব্যাখ্যায় তিতাসের আর্থিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর বিইআরসির আদেশ অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর হতে বিলড কনজাম্পশনের পরিবর্তে অ্যাকচুয়াল কনজাম্পশন বিবেচনা করা হয় এবং হাইয়ার হিটিং ভ্যালুর সমতুল্য গ্যাসের পরিমাণ গ্যাস বিক্রয়ের হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না করার ফলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গ্যাস বিক্রয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত গ্যাসের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় সিস্টেম লস (অংশ বিশেষ) এর বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়েছে।”

তবে এ দাবি নাকচ করে দিয়ে শামসুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিতাসের দাবি কোনোভাবেই সঠিক নয়। কারণ গ্যাসের প্রকৃত ভোগের (অ্যাকচুয়াল কনজাম্পশন) হিসাব বের করার সক্ষমতা তিতাসের নেই।

“তিতাস দাবি করছে, তাদের মোট গ্যাসের ১৬ ভাগ ব্যবহৃত হয় আবাসিকে। এ দাবি সঠিক নয়। আবাসিকে এর থেকে অনেক কম গ্যাস ব্যবহৃত হয়। তার মানে, গ্যাসের প্রকৃত হিসাবের কারণে কোম্পানি রাজস্ব হারাচ্ছে, কোম্পানির এমন দাবি সঠিক নয়।”

তিতাসের নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান অ্যাকচুয়ারি জেড হালিম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস আর্থিক প্রতিবেদনের বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর মন্তব্য করেছে।

বিইআরসির আদেশের বিষয়টি উল্লেখ করেই সিস্টেম লসের বিষয়ে নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানটি বলছে, “আদেশ অনুযায়ী বিতরণযোগ্য গ্যাসের জন্য তিতাস গ্যাসের নিজস্ব লাইন ও জিটিসিএলের লাইন দ্বারা সঞ্চালিত গ্যাসের উপর গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিগত ক্ষতি যথাক্রমে ২ শতাংশ ও ২ দমমিক ২৫ শতাংশ। সে হিসেবে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিগত ক্ষতি ২৩৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা হওয়া উচিৎ ছিল।

“ফলে ৩০ জুন ২০১৯ তারিখে সমাপ্ত বছরে অতিরিক্ত পদ্ধতিগত ক্ষতির কারণে কোম্পানির ৫৩১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। গ্যাস/রাজস্বের এই অতিরিক্ত ক্ষতি সম্ভবত অহিসাবভুক্ত/অবৈধ লাইনের মাধ্যমে অবৈধ ব্যবহারের কারণে হয়েছে।”

তদন্ত চালিয়ে দুদক বলেছিল, তিতাসে ‘সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি’ হয় গ্যাসের অবৈধ সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি

বাংলাদেশে উত্তোলিত গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে যে ছয়টি সরকারি কোম্পানি বিক্রি করে, তার মধ্যে তিতাসই বিক্রি করে ৫৬ শতাংশ। ঢাকাসহ ১২টি জেলায় গ্যাস বিক্রির দায়িত্ব তিতাসের।

দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জে বিপুল পরিমাণ অবৈধ গ্যাস সংযোগের তথ্য পেয়েছে তারা। তারা দেখেছে, আবাসিকের চেয়ে শিল্পেই অবৈধ সংযোগ বেশি।

“তিতাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী তিতাসে কর্মরত নয় এমন কিছু টেকনিক্যাল ব্যক্তির সাথে যোগসাজশে ঘুষের বিনিময়ে স্বাভাবিক সংযোগের পাশাপাশি রাতের আঁধারে অবৈধভাবে এসব সংযোগ দিয়ে থাকে।”

নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান অ্যাকচুয়ারি জেড হালিম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস মন্তব্য করেছে, “আর্থিক বিবরণীর নোট-৩৩ এ বর্ণিত ‘সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ ও সিস্টেম লস হ্রাসকরণ ব্যয়’ খাতে কোম্পানিটির ৯৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। নিরীক্ষাধীন বছরে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের জন্য এই অর্থ ব্যয় হয়েছে, যা নির্দেশ করে কোম্পানিতে অবৈধ গ্যাস সংযোগ আছে, যার কারণে কোম্পানি প্রতিবছর যথেষ্ট পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।”

তিতাসের আর্থিক প্রতিবেদনে টাকার অঙ্ক ছাড়াও কী পরিমাণ অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়, তার উল্লেখও রয়েছে।

২০১৮-১৯ বছরে তিতাস গ্যাস কারচুপি, অবৈধ সংযোগ, অনুমোদন অতিরিক্ত ক্ষমতার স্থাপনাসহ শিল্প, সিএনজি, ক্যাপটিভ পাওয়ার, বাণিজ্যিক ও আবাসিকে মোট ৭০১৮টি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে।

তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আল-মামুন সিস্টেম লস বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিডিনিউজ টোযেন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাইপলাইনে প্রায়ই কাজ করতে হয়। এছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান সড়কে কাজ করতে গিয়ে গ্যাসের লাইন ফুটো করে ফেলে। এসব কারণে লিকেজ হয়ে অনেক সময় গ্যাস বের হয়।”

গ্যাসের প্রকৃত ব্যবহার (অ্যাকচুয়াল কনজাম্পশন) নিরূপণ করতে গিয়ে এবং হিটিং ভ্যালুর উচ্চমান রাখতে গিয়েও শতাংশের হিসাবে গ্যাস কমে যাচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।

অবৈধ সংযোগ নিয়মিতই বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে বলে জানান মাসখানেক আগে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আসা মামুন।

তবে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে ক্যাবের উপদেষ্টা শামসুল বলেন, “যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করার কথা, তারা তা করে না। চাপ কমসহ বিভিন্ন কারণে গ্রাহকরা তাদের মূল্য অনুযায়ী গ্যাস পান না।”

গ্যাসের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে এবং গ্রাহকরা যেন না ঠকে, সেজন্য ২০১৫ সালে তিতাসকে প্রিপেইড মিটার স্থাপনের নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা এখনও বাস্তবায়ন না হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি।

২০১৯ সালের জুন নাগাদ তিতাসের সাত শ্রেণির গ্রাহক সংখ্যা ছিল ২৮ লাখ ৬৫ হাজার ৯০৭। এর মধ্যে দুই লাখের মতো গ্রাহক প্রিপ্রেইড মিটারের আওতায় রয়েছে।

গত বছরে তিতাস গ্যাস কিনেছে ১৭ হাজার ৫৭২ দশমিক ৮৯ মিলিয়ন ঘনমিটার। এর বিপরীতে সিস্টেম লস ও নিজস্ব ব্যবহার বাদ দিয়ে বিক্রি করেছে ১৬ হাজার ৫৬৯ দশমিক ০৫ মিলিয়ন ঘনমিটার।

গ্যাস বিক্রি, ন্যূনতম চার্জ, হাইয়ার হিটিং ভ্যালু, মিটার ভাড়া ও সারচার্জসহ ১৪ হাজার ১৫৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা আয় করেছে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিটি প্রকৃত মুনাফা করেছে ৪৬৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। সিস্টেম লসের কারণে বড় অঙ্কের রাজস্ব না হারালে কোম্পানিটি আরও বেশি লভ্যাংশ দিতে পারত বলে মনে করেন বিনিয়োগকারীরা।