অর্থপাচার: চাইলেই শুল্ক গোয়েন্দাদের তথ্য দিতে হবে ব্যাংকগুলোকে

বাণিজ্যের আড়ালে বিদেশে অর্থপাচার প্রতিরোধে একটি নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউ।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Dec 2019, 01:50 PM
Updated : 11 Dec 2019, 01:50 PM

‘প্রিভেনশন অব ট্রেড বেজড মানিলন্ডারিং’ শীর্ষক এই নীতিমালায় ব্যাংকগুলোকে অর্থপাচারের মামলা তদন্তে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরকে তাৎক্ষণিক সহায়তা দিতে বলা হয়েছে।

বৈদেশিক বাণিজ্যের কাজে নিয়োজিত সব ব্যাংক কর্মকর্তাকে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার বিষয়ে প্রশিক্ষণের আওতায় আনারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

পাশাপাশি সব ব্যাংককে অর্থপাচার রোধে নিজস্ব নীতিমালা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর সেই নীতিমালা ২০ মার্চের মধ্যে বিএফআইইউতে পাঠাতে বলা হয়েছে। ১ জুনের মধ্যে অবশ্যই তা কার্যকর করতে হবে।

বিএফআইইউ বলছে, চীন-ভারতের মতো দেশগুলো থেকে অর্থপাচার বেশি হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার প্রতিরোধে নীতিমালা করল।

এই নীতিমালা অর্থপাচার রোধে ‘কার্যকর’ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন বিএফআইইউ প্রধান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাণিজ্যের আড়ালে যাতে অর্থপাচার না হয় সেটা রোধ করতেই এই নীতিমালা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পাদনকারী ব্যাংকগুলো। ব্যাংকগুলো যাতে কঠোর হয় বা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে তাহলে অর্থপাচার রোধ করা সম্ভব।

এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই নীতিমালাটি জারি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

রাজি হাসান বলেন, “পৃথিবীর খুব কম দেশেই এ ধরনের নীতিমালা আছে। চার-পাঁচটা ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এ ধরনের নীতমালা আছে। আশা করছি, এটি ভালো ফল বয়ে আনবে।”

নীতিমালায় বলা হয়েছে, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, পাচারকৃত অর্থের বেশিরভাগ অর্থাৎ, ৮০ শতাংশেরও বেশি বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে পাচার হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন ও সংবাদ মাধ্যমেও বাংলাদেশ হতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি মানিলন্ডারিং বা অর্থ পাচার হচ্ছে মর্মে প্রকাশিত হয়েছে।

এছাড়াও বিএফআইইউ, দুদক ও সিআইডির যৌথ উদ্যোগে প্রণীত বাংলাদেশের মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন ঝুঁকি নিরূপন প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং ও বিদেশে অর্থ পাচারকে ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি-জিএফআই গত ২৯ জানুয়ারি অর্থ পাচার নিয়ে ‘ইলিসিট ফাইন্যান্সিয়াল ফ্লোজ টু অ্যান্ড ফ্রোম ১৪৮ ডেভেলপিং কান্ট্রিজ ২০০৬-২০১৫’ শিরোনামে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়, ট্রেড মিস ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ বাইরে চলে গেছে এমন শীর্ষ ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৮তম। একইভাবে অবৈধভাবে অর্থ দেশে প্রবেশ করেছে এমন প্রথম ৫০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের  মাধ্যমে অর্থপাচার হয় সবেচেয়ে বেশি। আমদানি পণ্য বা সেবার মূল্য বেশি দেখিয়ে অর্থপাচার হয়ে থাকে। বিপরীত দিকে রপ্তানি পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে অবশিষ্ট অর্থ বিদেশে রেখেও অর্থপাচার ঘটে থাকে।

পাশাপাশি আমদানিকৃত পণ্যের বিবরণ পরিবর্তন করে বা কোনো পণ্য আমদানি না করে শুধু ডকুমেন্টের বিপরীতে মূল্য পরিশোধ করেও অর্থপাচার হয়ে থাকে। এছাড়া একই পণ্য বা সেবার একাধিক চালান ইস্যু করে, ঘোষণার তুলনায় পণ্য বা সেবা বেশি বা কম জাহাজীকরণের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হয়ে থাকে।

বিএফআইইউ বলেছে, বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বিদেশে অর্থপাচারের এই প্রবণতা রোধে সমন্বিত উদ্যোগের আওতায় নীতিমালাটি তৈরি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিদেশে অর্থপাচারকে উচ্চ ঝুঁকি বিবেচনায় এ সম্পর্কিত কেস বিশ্লেষণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

পাচারকৃত অর্থ চিহ্নিত করতে কৌশলগত বিশ্লেষণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন উপমহাব্যবস্থাপকের নেতৃত্বে নয় সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির সুপারিশের আলোকেই মানিলন্ডারিং, সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় সংস্থা হিসেবে কার্যরত বিএফআইইউ নীতিমালাটি প্রণয়ন করেছে।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর, বিএফআইইউ, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ফোকাস গ্রুপ নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করে। পরে এটি সবার মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের সাথে আলোচনা এবং প্রাপ্ত মতামত/সুপারিশ পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।

“নীতিমালার আলোকে প্রতিটি ব্যাংক বাণিজ্যভিত্তিক মানিলন্ডারিং ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে নিজস্ব গাইডলাইন্স/ম্যানুয়েল প্রস্তুত করে ১০ মার্চের মধ্যে বিএফআইইউএ দাখিল করবে এবং ১ জুনের মধ্যে এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে।”