এর আগে কখনই এক সপ্তাহে এতো বেশি রেমিটেন্স বাংলাদেশে আসেনি।এই ধারা অব্যাহত থাকলে ডিসেম্বরে রেমিটেন্স ২০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছবে। আর তা হবে এক মাসের হিসাবে রেকর্ড।
এখন পর্যন্ত এক মাসে ১৭৪ কোটি ৮২ লাখ ডলার রেমিটেন্স পেয়েছে বাংলাদেশ; মে মাসে।
আর রেমিটেন্স প্রবাহের এই ইতিবাচক ধারায় বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ ফের ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে। অর্থনীতির প্রায় সব সূচক নিম্নমুখী। এই ‘বৈরি হাওয়ার’ মধ্যে একমাত্র রেমিটেন্সই আশার আলো ছড়াচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।
গত নভেম্বর মাসে ১৫৫ কোটি ৫২ লাখ (১.৫৫ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা ছিল গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ৩১ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।
আর চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রেমিটেন্স এসেছে ৭৭১ কোটি (৭.৭১ বিলিয়ন) ডলার। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি।
দুই শতাংশ হারে প্রণোদনা, জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার রেমিটেন্সের যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ডিসেম্বর মাসের আট দিনে (১ ডিসেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বর) ৫০ কোটি ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
এ নিয়ে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের পাঁচ মাস আট দিনে (১ জুলাই থেকে ৮ ডিসেম্বর) রেমিটেন্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮২৬ কোটি ৪২ লাখ (৮.২৬ বিলিয়ন) ডলার।
অক্টোবর মাসে ১৬৪ কোটি ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।যা ছিল এক মাসের হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স।তার আগেসেপ্টেম্বরে পাঠিয়েছিলেন ১৪৬ কোটি ৮৪ লাখ ডলার।
অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এসেছিল ১৫৯ কোটি ৭৭ লাখ ডলার।অগাস্টে আসে ১৪৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলার।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে সুখবর দিয়ে শেষ হয় ২০১৮-১৯ অর্থবছর। গত অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
তার আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রেমিটেন্সে প্রবৃদ্ধি ছিল আরও বেশি; ১৭ দশমিক ৩২ শতাংশ।
রেমিটেন্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।প্রবাসীরা এখন ১০০ টাকা দেশে পাঠালে যার নামে টাকা পাঠাচ্ছেন তিনি ঔ ১০০ টাকার সঙ্গে ২ টাকা যোগ করে ১০২ টাকা তুলতে পারছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা ঘোষণা করেছে। ৬ অগাস্ট তা প্রকাশ করা হয়েছে; তাতে বলা হয়েছে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে প্রণোদনা পেতে ১ হাজার ৫০০ ডলার পর্যন্ত কোন ধরনের কাগজপত্র লাগবে না।
তবে রেমিটেন্সের পরিমাণ এই অংকের বেশি হলে প্রাপককে প্রেরকের পাসপোর্টের কপি এবং বিদেশী নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগপত্র অবশ্যই জমা দিতে হবে।আর ব্যবসায়ী ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যবসার লাইসেন্সের কপি দাখিল করতে হবে।
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এক হাজার ৬৪১ কোটি ৯৬ লাখ (১৬.৪২ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসেছিল এক হাজার ৪৯৮ কোটি ১৭ লাখ (১৪.৯৮ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হল বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থ বা রেমিটেন্স।
বর্তমানে এক কোটির বেশি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। জিডিপিতে তাদের পাঠানো অর্থের অবদান ১২ শতাংশের মত।
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, একমাত্র রেমিটেন্স ছাড়া অর্থনীতির অন্য সব সূচকের অবস্থা এখন খারাপ। রপ্তানি বাণিজ্যে ধস নেমেছে। রাজস্ব আদায় কমছে। মূল্যস্ফীতি উর্ধ্বমুখী।চাপে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ।আমদানিও কমছে।বিনিয়োগে খরা কাটছে না।ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পাহাড়।শেয়ারবাজারে তো মন্দা লেগেই আছে।
“সে কারণেই বলা যায়, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সই এখন সচল রেখেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা।”
রপ্তানি আয় এবং রেমিটেন্স বাড়াতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কিছুটা কমিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এক মাসে আগে ৩১ অক্টোবর আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দর ছিল ৮৪ টাকা ৭০ পয়সা। পাঁচ মাস আগে ৩০ জুন ছিল ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা। এক বছর আগে ২৭ নভেম্বর ছিল ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা।
ডলারের দাম আরও বাড়ানোর পক্ষপাতি আহসান মনসুর বলেছেন, বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম ৮ থেকে ১০ শতাংশ বাড়াতে হবে।
“চীন, ভারত, ভিয়েতনামসহ প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের রপ্তানিকারক ও প্রবাসীদের সুবিধা দিতে তাদের মুদ্রার মান কমিয়েছে।ডলার শক্তিশালী করা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই। অর্থনীতির স্বার্থেই এটা করতে হবে।”
দীর্ঘদিন ডলার-টাকার বিনিময় হার ধরে রাখা ঠিক হয়নি মন্তব্য করে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর বলেন, “অনেক পিছিয়ে গেছি আমরা। আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো বিশ্ববাজার দখল করতে তাদের মুদ্রার মান অনেক কমিয়েছে; আমরা করিনি।”
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর মনে করেন, ডলারের দাম বাড়ালে রপ্তানি আয়ে বিপর্যয় যেমন কেটে যাবে, তেমনি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সও বাড়বে।
রিজার্ভ ফের ৩২ বিলিয়ন ডলার
রেমিটেন্স বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়নও (রিজার্ভ) সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে।সোমবার দিন শেষে রিজার্ভেরপরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রিজার্ভ ৩২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে উঠিছিল।এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল।
গত এক মাসে তা বেড়ে আবার ৩২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ- এই নয়টি দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যে সব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পর পর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।
৩৪ কোটি ডলার বিক্রি
এদিকে বাজারে ডলারের চাহিদা বাড়ায় বাজারে ডলার ছাড়া অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যংক। সোমবারও ১৫ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। এ নিয়ে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের সোমবার পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৩৪ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
এর মধ্যে জুলাই মাসে বিক্রি করে ৩ কোটি ৬০ ডলার, আগস্টে ২ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
চাহিদা না থাকায় সেপ্টেম্বরে কোনো ডলার বিক্রি করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। অক্টোবরের মাঝামাছি সময় থেকে চাহিদা বেড়েছে বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
সাধারণত ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে চাহিদা তৈরি হলে ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছে ২৩৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়।