নওরিনের মতো এই মনোভাব আরও অনেকের। ব্যাংকে টাকা রাখলে যে সুদ পাওয়া যায় তা মূল্যস্ফীতি ‘খেয়ে ফেলে’। একটার পর একটা অনিয়ম- দুর্নীতি-কেলেঙ্কারিতে ব্যাংক ব্যবস্থায় তৈরি হয়েছে আস্থার ঘাটতি। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে সাম্প্রতিক সময়ে মুনাফা করেছেন এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুস্কর।
সাধারণের কাছে বিনিয়োগের আকর্ষণীয় একটাই পথ ছিল সঞ্চয়পত্র। করের হার বৃদ্ধি এবং কড়াকড়ি আরোপ করায় সেখান থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে মানুষ।
এই অবস্থা যেন স্বাধীনতার পর ব্যাংকগুলোর একটি বিজ্ঞাপনের কথা মনে করিয়ে দেয়। সে সময় সবার নজর কাড়া বহুল প্রচারিত বিজ্ঞাপনটি ছিল, ‘চঞ্চল টাকা অঞ্চলে (আঁচলে) রেখো না’।
আমানত বাড়াতে টাকা খরচ করে ওই প্রচারণা চালাত ব্যাংকগুলো। কিন্তু অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, অনেকটা বাধ্য হয়েই মানুষকে টাকা ‘অঞ্চলে’ রাখতে হচ্ছে।
তাদেরই একজন মিরপুরের বাসিন্দা সাবিনা ইয়াছমিন। তার স্বামী থাকেন সিঙ্গাপুরে। প্রতি মাসে স্বামী যে টাকা পাঠান বাসা ভাড়া, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়াসহ অন্যান্য খরচ মিটিয়ে যা অবশিষ্ট থাকত তা দিয়ে কয়েক বছর আগে পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন সাবিনা।
‘আগে যা মুনাফা পাওয়া যেত এখন তার অনেক কম পাওয়া যায়’ জানিয়ে হতাশার সুরে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রথম যখন কিনি মাসে প্রতি লাখে ১ হাজার ৭০ টাকা পেতাম। ২০১৫ সালের মে মাসে মুনাফার হার কমানো হলে পেতাম ৯১২ টাকা। এখন করের হার বাড়ানোয় পাচ্ছি ৮৬৪ টাকা।
“তাছাড়া নতুন করে সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন লাগবে। আরও কত নিয়ম-কানুন! কি আর করব এখন যা খরচ-টরচ করে বাঁচে, তা বাসায়ই রেখে দেব।”
সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমছে লাফিয়ে লাফিয়ে
সাবিনা ইয়াছমিনের আক্ষেপের প্রমাণ পাওয়া যায় জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যে।
ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার কম এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে গত কয়েক বছর ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল সঞ্চয়পত্র বিক্রি। কিন্তু বিক্রির চাপ কমাতে ১ জুলাই থেকে মুনাফার উপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়।
একইসঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে কোনো সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে না মর্মে শর্ত আরোপ করা হয়।
আর এ সব কারণে এখন সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমছে। তথ্যে দেখা যায়, যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল এখন সেভাবেই লাফিয়ে লাফিয়ে কমছে।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য ঘেটে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মাসে ৯৮৫ কোটি ৭১ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে হয়েছিল প্রায় চার গুণ বেশি, ৪ হাজার ৩৫৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
আর চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৪ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত বছরের এই তিন মাসে বিক্রির পরিমাণ ছিল তিন গুণ বেশি, ১৩ হাজার ৪১২ কোটি টাকা।
তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে যে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে গত বছরের এক মাসেই (সেপ্টেম্বর) তার সমান সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল।
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ৮৬ হাজার ৭২০ কোটি ২৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছিল ৩৮ হাজার ৭৭৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এ হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৭ হাজার ৯৪৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
তার আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭৮ হাজার ৭৮৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ৫৩০ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়।এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
২০১৫ সালের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার গড়ে ২ শতাংশ করে কমানো হয়। তার আগে পাঁচ বছর মেয়াদি এক লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র থেকে প্রতি মাসে ১ হাজার ৭০ টাকা মুনাফা পাওয়া যেত।
সুদের হার কমানোর ফলে পাওয়া যেত ৯১২ টাকা। জুলাই মাস থেকে করের হার বাড়ানোর ফলে পাওয়া যাচ্ছে ৮৬৪ টাকা।
তবে পাঁচ লাখ টাকার কম বিনিয়োগ হলে প্রতি লাখে মাসে ৯১২ টাকাই মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ভবনের নিচতলায় মতিঝিল অফিসে গিয়ে দেখা যায়, আগের মতো সেই ভিড় নেই। কিছু সংখ্যক লোক মাসের মুনাফার টাকা তুলতে এসেছেন। ৭-৮ জন নতুন সঞ্চয়পত্রের জন্য টাকা জমা দিচ্ছেন।
অথচ আগে এই অফিস প্রতি দিনই গ্রাহকদের উপস্থিতিতে গমগম করত। লম্বা লাইন লেগেই থাকত। রাত ৮-৯টা পর্যন্ত কাজ করতে হত কর্মকর্তাদের।
বিক্রির চাপ বেশি থাকায় আগে যেদিন সঞ্চয়পত্রের টাকা জমা দেওয়া হত, তার দুই-আড়াই মাস পর প্রয়োজনীয় কাগজ (ডকুমেন্ট) গ্রাহককে দেয়া হত। এখন এক-দুই দিন পরই দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যাংক আমানতের সুদের হারের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার অনেক বেশি হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরেই সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হচ্ছিল।
পুঁজিবাজারেও দীর্ঘদিন ধরে মন্দা চলছে। সব মিলিয়ে যাদের সঞ্চয় ছিল তারা ‘নিরাপদ’ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রকেই বেছে নিয়েছিল।
“কিন্তু করের হার বৃদ্ধির কারণে এখন কম মুনাফা পাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এছাড়া টিআইএন এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সব মিলিয়ে সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সবাই।”
তবে ভবিষৎ ঋণের বোঝা কমাতে সরকারের এছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না বলে মনে করেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত।
ব্যাংকে টাকা রাখলে ‘লস’
ব্যাংকের চলতি হিসাবে টাকা থাকলে তিন-সাড়ে তিন শতাংশের বেশি সুদ পাওয়া যায় না। আর ডিপিএস বা এফডিআরের সুদ ছয়-সাড়ে ছয় শতাংশের বেশি মেলে না। এর উপর ঘণ্টায়-ঘণ্টায় এসএমএসসহ দিনে-মাসে-বছরে নানা চার্জ কেটে রাখে ব্যাংকগুলো।
অর্থনীতিতে যে কোনো হিসাব কষতে গেলে মূল্যস্ফীতি সামনে চলে আসে। পরিসখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাবে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
আমানতের সুদ থেকে মূল্যস্ফীতি এবং চার্জ বাদ দিলে ব্যাংকে টাকা রাখলে আসলে কোনো মুনাফা পাওয়া যায় না; উল্টো ‘লস’ বা ‘লোকসান’ হয়।
এছাড়া বেসিক, ফারমার্স, জনতাসহ বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি-অনিয়ম এবং বিশাল অংকের খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা দিন দিন কমে যাচ্ছে বলে মনে করেন জায়েদ বখত।
পুঁজিবাজারের করুণ দশা
পুঁজিবাজারের অবস্থা আরও করুণ। মূল্যসূচক কমছেই। লেনদেন নেমে এসেছে তলানিতে। ২০১০ সালের ধসের পর নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। উল্টো দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতি ততোই খরাপের দিকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক একচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৪ হাজার ৭০০ পয়েন্টে নেমে এসেছে। লেনদেন নেমে এসেছে ৩০০ কোটি টাকার ঘরে।
২০১০ সালে চাঙ্গা বাজারে এই সূচক ৯০০০ পয়েন্টে উঠেছিল, লেনদেন চড়েছিল ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকায়।
বছর খানেক আগেও ডিএসইএক্স ৬০০০ পয়েন্ট অতিক্রম করেছিল। লেনদেন ছাড়িয়েছিল ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রশীদ চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খুবই খারাপ অবস্থা। গত এক-দেড় বছরে বাজার থেকে কেউ লাভ করেছে এমন বিনিয়োগকারী খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবাই লোকসানে। এভাবে বাজার চলতে পারে না।
“কারো কোনো নজর নেই বাজারে। বাজার বাঁচাতে আমরা ২১ দফা দিয়েছিলাম। তারও কোনো খবর নেই। আমরা সবাই হতাশ-ক্ষুব্ধ।”