আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডে অনলাইন লেনদেনে ‘অনুমতির’ ভোগান্তি

ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে অনলাইনে বিদেশ থেকে পণ্য বা সেবা কেনার জন্য ব্যাংকের কাছ থেকে আগে ছাড়পত্র নেওয়ার নিয়ম জারি হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীসহ সাধারণ গ্রাহকরা।

ফারহান ফেরদৌস নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Nov 2019, 09:20 AM
Updated : 21 Nov 2019, 06:46 PM

এক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার জারির পর থেকে অনলাইনে বিদেশি পণ্য বা সেবা কিনতে ডলার পরিশোধের ক্ষেত্রে কার্ড ব্যবহারকারীদের নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে জমা দিয়ে ব্যাংকের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, অনলাইনে ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনা ও জুয়া ও লটারিতে অংশ নেওয়াসহ আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের ‘অপব্যবহার’ রোধের লক্ষ্যে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তবে এ নিয়ম ‘বাস্তবসম্মত নয়’ মন্তব্য করে ব্যাংকার ও গ্রাহকরা বলছেন, এই পদ্ধতিতে ব্যাংকের ব্যয় বাড়বে, গ্রাহকদেরও ভোগান্তি হবে। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে এমন গুরুতর সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি।

ডোমেইন ও হোস্টিং সেবার পাশাপাশি গ্রাহকদের জন্য ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্টের কাজ করে থাকে ‘বাংলাদেশ কনসালট্যান্ট’ নামে একটি কোম্পানি।

এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বাকি বিল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নতুন ওয়েব পেইজের জন্য থিম কিনতে আমাদের নিয়মিত আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে হয়। নতুন নিয়মের কারণে আমাদের এই কার্যক্রম এখন বন্ধ, আমরা আমাদের গ্রাহকদের সেবা দিতে পারছি না। কারণ প্রতিটি ট্রানজেকশনের আগে ফরম ফিলাপ করে ব্যাংকে গিয়ে জমা দেওয়া একেবারেই অবাস্তব।”

তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠান স্পেকট্রাম সফটওয়্যার অ্যান্ড কনসালটিং লিমিটেডের ম্যানেজিং পার্টনার মুশফিকুর রহমান বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন সার্কুলারের কারণে আমাদের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে; ব্যবসার উপর বড় প্রভাব পড়ছে।

“আমরা যে সফটওয়্যার ব্যবহার করি, তার জন্য মাঝেমধ্যেই আমাদের টুলকিট কিনতে হয়, এর দাম ৫০০ থেকে ১০০০ ডলার হয়ে থাকে। এটা আমাদের দিনে কখনো তিনবারও কিনতে হয়।”

এছাড়া আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডে আরও অনেক ধরনের লেনদেন হয়, যেগুলো তাৎক্ষণিকভাবেই করতে হয়। সেক্ষেত্রেও সমস্যায় পড়েছেন বলে তিনি জানান।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বেসিসের সহসভাপতি (অর্থ) মুশফিকুর বলেন, “সরকার বেসিসের সদস্যদের বছরে ৩০ হাজার ডলার পর্যন্ত ব্যয় করার অনুমতি দিয়ে রেখেছে। কিন্তু এই সার্কুলারের কারণে আমাদের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ গত বৃহস্পতিবার জারি করা সার্কুলারে বলেছে, আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড দিয়ে অনলাইনে বিদেশি পণ্য বা সেবা কিনতে হলে গ্রাহককে অনলাইন ট্রানজেকশন অথরাইজেশন ফর্ম (ওটিএএফ) পূরণ করে মোবাইল অ্যাপ বা ইন্টারনেট প্লাটফর্মের মাধ্যমে বা হার্ড কপি ব্যাংকে জমা দিতে হবে।

ব্যাংক যাচাই-বাছাই করে অসঙ্গতি না পেলে ক্রেডিট কার্ডকে শুধু সেই লেনদেনের জন্য সক্রিয় করে দেবে। অনুমোদন ছাড়া অনলাইনে ডলারের কেনাকাটায় কার্ড কাজ করবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী শাহ আলী ফরহাদও। তিনি এক ফেইসবুক পোস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের শুভবুদ্ধির উদয় হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-পরিচালক নাসিম উদ্দিন বলেন, স্থানীয় মুদ্রায় বাংলাদেশ থেকে অনলাইনে কেনাকাটা করার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। কেউ যদি দেশের বাইরে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন করেন, সেটাও এর আওতার বাইরে থাকবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সিদ্ধান্তটি ‘বাস্তবসম্মত নয়’। এতে ব্যাংকের কাজ ও খরচ বাড়বে; সময় নষ্ট হবে। গ্রাহকদেরও ভোগান্তি ও ব্যয়- দুটোই বাড়বে।

মোবাইল অ্যাপ বা ইন্টারনেটে ‘ওটিএএফ’ জমা দেওয়ার ব্যবস্থা যুক্ত করার কারিগরি কাজটি সময়সাপেক্ষ। আগে নির্দেশনা না দেওয়ায় ব্যাংকগুলো প্রস্তুতিও নিতে পারেনি। ফলে হঠাৎ করেই আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডে অনলাইন লেনদেন ডিজিটাল থেকে ম্যানুয়াল হয়ে গেছে।

ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এবিবি) ও ব্যাংকের নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “আমরা সার্কুলারের দিন থেকেই লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছি। গ্রাহকদের (ওটিএএফ) ফরম ফিলাপ করে লেনদেন করতে হচ্ছে। তবে আমরা ফরমটি এখনো ওয়েবসাইটে দিতে পারিনি।

“গ্রাহকদের অনেক সমস্যা হচ্ছে, গ্রাহকরা অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। এ ধরনের সার্কুলার দেওয়ার আগে একটু আলোচনা করে নিলে সুবিধা হয়।”

অনলাইনে বিদেশি পণ্য ও সেবা কেনায় এই কড়াকড়ির কারণে অর্থ পাচার বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড আসার আগেও মানুষ কিন্তু প্রয়োজনীয় লেনদেন করত। এখন এটা বন্ধ হলে আবার হুন্ডির মাধ্যমে করবে, সরকার রাজস্ব পাবে না। এ ‍বিষয়টি মাথায় রেখে কাজটা করতে হবে।”

ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশে বসে বাইরে লেনেদেন করতে হলে এখন আবেদন করা লাগবে, ফলে অপব্যবহার কমবে। কিন্তু সেবা পেতে গ্রাহকদের একটু দেরি হবে। কখনো কখনো এই আবেদন প্রক্রিয়া গ্রাহকদের জরুরি প্রয়োজন পূরণে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।”

এবিষয়ে ব্যাংকগুলোর আপত্তি ও গ্রাহকদের ভোগান্তি নিরসনে আলোচনার জন্য সোমবার ব্যাংকের নির্বাহী ও বেসিসের প্রতিনিধিদেরকে বৈঠকে ডাকা হয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-পরিচালক নাসিম উদ্দিন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা জানতে পেরেছি যে, আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনা হচ্ছিল। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে জুয়া খেলা ও লটারির টিকেট নিষিদ্ধ হলেও এগুলো করা হচ্ছিল। এ ধরনের অপব্যবহার বন্ধ করতে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি।”

বেসিস সহসভাপতি মুশফিকুর বলেন, “আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। আশা করি সামনের সপ্তাহে এবিষয়ে একটি ভাল সংবাদ পাব।”

২০১৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এক সার্কুলারে আন্তর্জাতিক পণ্য কেনাকাটায় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী গ্রাহকদের এককভাবে কোনো পণ্য বা সেবামূল্যের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩০০ ডলার পর্যন্ত পরিশোধের সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে তা কোনো অবস্থাতেই বছরে এক হাজার ডলারের বেশি হবে না।