লেনদেন ভারসাম্যে ফের ঘাটতি

ফের ঘাটতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য-ব্যালান্স অফ পেমেন্ট।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Nov 2019, 04:09 PM
Updated : 7 Nov 2019, 04:09 PM

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অথচ অগাস্ট মাস শেষেও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

রপ্তানি আয়ে বড় ধাক্কার কারণে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, গত দুই অর্থবছরে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে বড় ঘাটতি নিয়ে বছর শেষ হয়েছিল। কিন্তু এবার অর্থবছর শুরু হয়েছিল ‘স্বস্তির’ মধ্য দিয়ে ২৪ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত নিয়ে। অগাস্ট পর্যন্ত সেই উদ্বৃত্ত ধরে রাখা গিয়েছিল।

“কিন্তু রপ্তানিতে বড় ধাক্কার কারণে সেটা আর ধরে রাখা যায়নি। গত দুই বারের মতো এবারও মনে হচ্ছে বড় ঘাটতিতে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কেননা, সহসা রপ্তানি আয় ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।”

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, গত অর্থবছরে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্সে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঘাটতি থাকলেও সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্যে (ওভারওল ব্যালান্স) উদ্বৃত্ত ছিল। এবার তিন মাসে সেটাতেও বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে।”

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) লেনদেন ভারসাম্যে চলতি হিসারের ভারসাম্যে ৬৭ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ঘাটতি (ঋণাত্মক) দেখা দিয়েছে। গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল আরও বেশি ১৩১ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

এই তিন মাসে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। জুলাই-অগাস্ট সময়ে উদ্বৃত্ত ছিল ১৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার।গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ঘাটতি ছিল ১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

তবে আর্থিক হিসাবে (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এই উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৩৮ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৩০ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

চলতি হিসাবের ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শুরু করেছিল বাংলাদেশ। প্রথম মাস জুলাইয়ে ২৪ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।অগাস্ট শেষে উদ্বৃত্ত দাঁড়ায় ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

চলতি হিসাবের ভারসাম্য ৫২৫ কোটি ৪০ লাখ ডলারের বড় ঘাটতি (ঋণাত্মক) নিয়ে শেষ হয়েছিল গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল আরও বেশি ৯৫৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাব উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হল, নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

বাণিজ্য ঘাটতি ৩.৭২ বিলিয়ন ডলার

লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বাড়ায় পণ্য বাণিজ্যেও ঘাটতি বাড়ছে।জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৭১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় একই; ৩৮৫ কোটি ২০ লাখ ডলার।

জুলাই-সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) মোট এক হাজার ৩২৫ কোটি ২০ লাখ (১৩.২৫ বিলিয়ন) ডলার ব্যয় করেছে বাংলাদেশ। আর পণ্য রপ্তানি থেকে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) আয় হয়েছে ৯৫৩ কোটি ৫০ লাখ (৯.৫৩ বিলিয়ন) ডলার।

এ হিসাবেই বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৭১ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

তথ্যে দেখা যায়, এই দুই মাসে আমদানি ব্যয় কমেছে ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আর রপ্তানি আয় কমেছে ২ দশমিক ১৮ শতাংশ।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পুরো সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫৪৯ কোটি ৪০ লাখ (১৫.৪৯ বিলিয়ন) ডলার।২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল আরও বেশি ১৮ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।

সেবা খাতের ঘাটতি ১ বিলিয়ন ডলার

সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে।জুলাই-সেপ্টেম্বর এ খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ৭৬ কোটি ১০ লাখ ডলার।

মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।

এফডিআই বেড়েছে ৭.১২%

গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে।

গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ১০৩ কোটি ২০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশে। এই বছরের একই সময়ে এসেছে ১১০ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

এ হিসাবে তিন মাসে এফডিআই বেড়েছে ৭ দশমিক ০৭ শতাংশ।

এই তিন মাসে বাংলাদেশে নিট এফডিআই এসেছে ৬৪ কোটি ২০ লাখ ডলার। আগের বছরে একই মাসে এসেছিল ৫৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকেই নিট এফডিআই বলা হয়ে থাকে।

পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগে খরা

তবে পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) প্রবাহের গতি গতবারের মতোই হতাশাজনক।

২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে মাত্র ৩ কোটি ৫০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল আরও কম; ২ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

জুলাই-সেপ্টেম্বরে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাবদ বাংলাদেশে এসেছে ৯০ কোটি ১০ লাখ ডলার। গত বছরের এই তিন মাসে এসেছিল ৯২ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

এআরএইচ/৯.৪৪