সঞ্চয়পত্র: সুদ-আসলেই ৩৯ হাজার কোটি টাকা

গত অর্থবছরে সবমিলিয়ে প্রায় ৮৭ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯ হাজার কোটি টাকাই চলে গেছে সুদ-আসল পরিশোধে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Sept 2019, 05:21 PM
Updated : 21 Sept 2019, 05:38 PM

এই অংক আগের বছরের চেয়ে ২০ দশমিক ২১ শতাংশ বেশি।

সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সুদ-আসল পরিশোধের পরিমাণ।জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সুদ-আসল পরিশোধে ব্যয় হয় ১২ হাজার ৬০২ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা বেড়ে ১৩ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ খাতে খরচ হয় ২০ হাজার ২৪ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে খরচ হয় ২২ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে ৩২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকায় ঠেকে।

সর্বশেষ গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে ৩৮ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ব্যাংকের আমানতের সুদের হারের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার অনেক বেশি হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরেই সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হচ্ছিল। যার ফলে সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে গিয়েছিল। তার মাশুল দিতে হচ্ছে এখন।

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

সে হিসাবে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ হচ্ছে ৪৭ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা।

অর্থ্যাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ৮৬ হাজার ৭২০ কোটি টাকা বিক্রি থেকে ৩৮ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা সুদ-আসল বাবদ পরিশোধের পর যে ৪৭ হাজার ৯৪৬ হাজার কোটি টাকা অবশিষ্ট ছিল সেটাই হচ্ছে নিট বিক্রি।

তবে বিক্রির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি এবং মুনাফার উপর কর বাড়ানোর ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অনেক কমে গেছে। তাই খরচ মেটাতে সরকারকে বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে।

চলতি অর্থবছরের দেড় মাসেই বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে সরকার। এ কয়েক দিনের নেওয়া ঋণ গত অর্থবছরের পুরো সময়কে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের দেড় মাসে (১ জুলাই থেকে ১৫ অগাস্ট) ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার ।

অর্থবছরের পুরো সময়ে (১২ মাসে, ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন) ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা আছে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ২৬ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিল সরকার।

অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজস্ব আদায় কম।কড়াকড়ি এবং কর বাড়ানোর ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রিও অনেক কমে গেছে। তাই খরচ মেটাতে সরকারকে বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে।”

রাজস্ব আদায় না বাড়লে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

“সেক্ষেত্রে বেসরকারি খাত ঋণ কম পাবে। বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বড় বড় প্রকল্পে সরকারের খরচ বাড়ায় ঋণ নির্ভরতা বেড়েছে বলে মনে করেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত।

চলতি অর্থবছর তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত অর্থবছরের মূল বাজেটে রাজস্ব আহারণের লক্ষ্য ছিল ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। আশানুরূপ আদায় না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়; যদিও শেষ পর্যন্ত আদায় হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরের শুরুতেও রাজস্ব আদায়ের গতি ভালো না।প্রথম মাস জুলাইয়ে ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২ হাজার ১৬০ কোটি ১৭ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এই অংক গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে অর্ধেকেরও কম।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৩৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।

বিক্রির চাপ কমাতে চলতি বাজেটে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার উপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একইসঙ্গে সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শণাক্তকরণ নম্বর) এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলকসহ আরও কিছু নতুন শর্তের কারণে সঞ্চয়পত্র কমে গেছে মনে করছেন বিআইডিএসের গবেষক জায়েদ বখত।

মুনাফার উপর করের হার বৃদ্ধির কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কম হবে ধরে নিয়ে এবারের বাজেটে এ খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য কম ধরেছে সরকার।

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের লক্ষ্য ধরা আছে ২৭ হাজার কোটি টাকা।

গত অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাত থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে করা হয় ৪৫ হাজার কোটি টাকা।

অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্রে ঋণের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা।