পরিবর্তনের প্রয়োজনেই বদলাবে ব্র্যাক: আসিফ সালেহ

সক্রিয় দায়িত্ব থেকে ফজলে হাসান আবেদ অবসর নিলেও তার দেখানো পথে পরিবর্তনের প্রয়োজনেই ব্র্যাক তার নতুন পথরেখা সাজাবে বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ।

নুরুল ইসলাম হাসিব জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 August 2019, 06:19 PM
Updated : 7 August 2019, 06:24 PM

আর এতে সফল হতে তার আশায় ভিত দিচ্ছে বিশ্বে সর্ববৃহৎ এনজিওটির প্রায় অর্ধশতকের পথচলার ইতিহাস।

“ব্র্যাক সব সময় সময়ের আগে ছিল,” এক কথায় বলেন আসিফ সালেহ। সেই সঙ্গে জানান, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়নে কাজের জায়গা থেকে সরে আসবে না সংস্থাটি।

প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকের চেয়ারপারসনের পদ ছাড়াসহ পরিচালনা পর্ষদে বড় ধরনের পরিবর্তন আসার পরদিন বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্য’ নিয়ে কথা বলেন নতুন নির্বাহী পরিচালক।

সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি নানা সংস্থায় উন্নয়ন বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা নিয়ে গত ১ অগাস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব নেন আসিফ সালেহ।

সক্রিয় ভূমিকা থেকে বিদায় নেওয়ার আগে চিন্তা-ভাবনা করেই নিজের হাতে গড়া সংগঠনটির পরবর্তী নেতৃত্ব নির্বাচনের যে সিদ্ধান্ত ফজলে হাসান আবেদ নিয়েছেন, তারই আলোকে আসিফ সালেহর এই দায়িত্ব গ্রহণ।

কাজের মধ্য দিয়েই সেই আস্থার প্রতিদান দিতে চান আসিফ সালেহ।

“উনার (ফজলে হাসান আবেদ) জন্য এটাই বড় প্রাপ্তি হবে যে সংগঠনটা ঠিকমতো চলছে,” বলেন তিনি।

আর এই পথচলায় যে ফজলে হাসান আবেদই হবেন অনুপ্রেরণার উৎস, সেটা জানাতেও ভোলেননি ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক।

“আবেদ ভাই আর ব্র্যাক পরিপূরক, তিনি একটা বটবৃক্ষের মতো, তিনি একটা ইনস্পিরেশনের জায়গা, মোটিভিশনের জায়গা। ফরমাল রোল থেকে তিনি চেয়ার এমেরিটাস হয়েছেন, আমাদের জন্য এটা বড় ধাক্কা যে উনার ওই প্রেজেন্সটা থাকবে না। তবে এর মানে এটা নয় যে উনি নেই।”

কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের পর স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে ১৯৭২ সালে ব্র্যাক গড়ে তোলেন ফজলে হাসান আবেদ; ২০০১ সাল পর্যন্ত এর নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালনের পর তিনি চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নেন।

৩৬ বছর বয়সে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফজলে হাসান আবেদ

চেয়ারপারসনের দায়িত্ব ছাড়ার পর আবেদের নতুন ভূমিকা নিয়ে ব্র্যাকের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “চেয়ার এমেরিটাস হিসেবে তিনি ব্র্যাকের কৌশলগত পরিকল্পনার সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকবেন। আগামী দিনগুলোতে ব্র্যাকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও বিশ্বব্যাপী এর প্রভাব ও অবস্থান কিভাবে আরও শক্তিশালী করা যায়, তা নিয়ে কাজ করবেন তিনি।”

এর ব্যাখ্যায় আসিফ সালেহ বলেন, বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বের নানা স্থানে ব্র্যাক সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো সংস্থা রয়েছে, যেখানে ঐক্যের প্রতীক ছিলেন ফজলে হাসান আবেদ।

“এগুলোর সবার একটা কমন ভিত ছিলেন উনি। এই কমন ভিতের বাইরে এটাকে কীভাবে একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দেওয়া যায়, গ্লোবাল গভার্নেন্স কীভাবে হবে, সেটা নিয়ে দুই-তিন মাস সময় দিয়ে একটা কাঠামোগত রূপ দিতে চান তিনি।”

আবেদের নির্দেশিত সেই পথরেখা ধরে ‘অপারেশনাল’ কাজগুলো শুরু হবে বলে জানান আসিফ সালেহ।

চ্যালেঞ্জগুলো নিতে হবে, বলছেন আসিফ সালেহ

ব্র্যাককে একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে না তুলতে আবেদের প্রয়াস তুলে ধরে তিনি বলেন, “উনি সবসময় বলে আসছেন যে ব্র্যাক কোনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান হবে না, সংগঠনের পরিচয়টা দরকার। উনি সবসময় চাইতেন যে সংগঠন যেন তার উপর ডিপেন্ডেন্ট না হয়।”

বাংলাদেশে যাত্রা শুরুর পর এখন বিশ্বের ডজন খানেক দেশে ছড়িয়ে আছে ব্র্যাক; বাংলাদেশেও রয়েছে আড়ংয়ের মতো এর অনেকগুলো ‘এন্টারপ্রাইজ’।

একাত্তরে শরণার্থী জীবন থেকে ফিরে আসা বাংলাদেশিদের নিয়ে শুরুর পর গণশিক্ষা থেকে শুরু করে দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের মতো কাজের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত হয় ব্র্যাকের কার্যক্রম।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় সেই প্রেক্ষাপট অনেক বদলেছে। ২০২১ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে রয়েছে বাংলাদেশ। শিক্ষায় এগিয়েছে, দারিদ্র্য বিমোচনেও এসেছে সাফল্য। অনেকের ধারণা, এতে এনজিওগুলোর কাজের ক্ষেত্র অনেকটাই কমে যাবে।

এই প্রসঙ্গে আসিফ সালেহ বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চ্যালেঞ্জও বদলাবে, আর সেই চ্যালেঞ্জই নেবে ব্র্যাক।

“নতুন যে সামাজিক সমস্যাগুলো আসবে, সেই চ্যালেঞ্জগুলো নিতে হবে।”

যেসব ক্ষেত্রে সরকার তেমন এগিয়ে আসছে না, লাভ হবে না দেখে বেসরকারি খাতও আগ্রহী হয় না, সেখানে সামাজিক সংগঠন হিসেবে ব্র্যাক এগিয়ে আসবে বলে জানান তিনি।

কাজ করার ক্ষেত্রের অভাবও দেখছেন না আসিফ সালেহ।

তার চোখে, যুবসমাজকে দক্ষ করে তোলা, অপরিকল্পিত নগরায়নের সমস্যা মোকাবেলা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার কাজটি সামনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেবে।

“এই জায়গাগুলোতে কাজ করার অনেক আছে। সেই সঙ্গে পুরনো জায়গাগুলোতেও কাজ করার রয়েছে; যেমন শিক্ষা। কাজ করার ক্ষেত্রের অভাব নেই।”

আসিফ সালেহর মতে, কাজের ক্ষেত্রের অভাব নেই

বাংলাদেশে এখন এনজিওগুলোর বিদেশ থেকে তহবিল পাওয়ার সুযোগ কমে আসার বিষয়টি মাথায় রয়েছে বিশ্বের নামি আর্থিক সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাকসে এক যুগ কাজ করে আসা আসিফ সালেহর; সেজন্য নিজস্ব তহবিল গড়ার উপর জোর দিচ্ছেন তিনি।

আড়ংসহ সংশ্লিষ্ট নানা সংস্থার আয় এবং নানা বিনিয়োগের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “ব্র্যাকের একটা নিজস্ব আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে।”

এক্ষেত্রেও ফজলে হাসান আবেদের চিন্তাধারার বিষয়টি তুলে ধরে আসিফ সালেহ বলেন, “তিনি চাইতেন, ডোনার ডিপেন্ডেন্সিতে না থেকে আমরা যেন স্বাবলম্বী হতে পারি, বিভিন্নমুখী অর্থনৈতিক সোর্স থাকে।”

তহবিল সঙ্কট মোকাবেলায় এটাকেই ‘বড় কৌশল’ হিসেবে দেখছেন তিনি।

পথচলায় সমস্যা আসবেই- তা ধরে নিয়ে সেটা মোকাবেলা করেই এগিয়ে যাওয়ার পথ ঠিক করেছেন আসিফ সালেহ।