তারা কী চায়, প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিরোধিতায় যারা আন্দোলন করছে, তারা প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারছে না।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 July 2019, 04:51 PM
Updated : 11 July 2019, 04:54 PM

বৃহস্পতিবার সংসদের বাজেট অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে একথা বলার পাশাপাশি গ্যাসে কীভাবে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে এবং প্রতিবেশী দেশের তুলনায় বাংলাদেশে দাম কতটা কম, তার চিত্রও তুলে ধরেন তিনি।

উচ্চ দামে আমদানি করা এলপিজিতে ভর্তুকির ভার লাঘবের জন্য সরকার এই জুলাইয়ে গ্যাসের দাম সব পর্যায়ে গড়ে ৩২.৮ শতাংশ বাড়িয়েছে।

এই দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে হরতাল করেছে বাম দলগুলো, বিরোধিতা করেছে বিএনপি। আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী দলগুলোও গ্যাসের দাম বাড়ানো নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে।

সরকার গ্যাসের দাম বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে বলে মনে করেছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা অধিকার কর্মীরা। 

প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেন, “আমি জানি না, যারা গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে আন্দোলন করছেন, তারা তাহলে কী চান? আমরা তো ভর্তুকি দিয়েই নিয়ে আসছি। আমাদের রাজস্ব আয় কমে যাচ্ছে। তারপরও আমরা জনগণের কাছ থেকে নিচ্ছি না। খরচটা বিবেচনায় নিতে হবে।

“আমরা গ্যাস যদি দিতে না পারি, তাহলে কী হবে? উৎপাদন ব্যাহত হবে, রপ্তানি ব্যাহত হবে, কর্মসংস্থানও বন্ধ হয়ে যাবে। সারাদেশে হাহাকার শুরু হবে।”

আগের সঙ্গে এখনকার তুলনা করে শেখ হাসিনা বলেন, “যখন গ্যাস ছিল না, গ্যাসের জন্য হাহাকার। তখন আমাদের ব্যবসায়ীরা বলেছে, যত দাম লাগে এনে দেন, আমরা দেব। আমরা সেটাই করেছি।

“কিন্তু এখন যারা আন্দোলন করছেন, আমি জানি না। অনেক কথাই বলছেন, অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা বলছেন। কিন্তু প্রকৃত অবস্থাটা তারা চিন্তা করছেন না বা আমাদের উন্নয়নটা তারা দেখতে পাচ্ছেন না। এটাই হচ্ছে দুঃখজনক।”

সরকার প্রধান বলেন, তারা চেষ্টা করছেন ভর্তুকি দিয়ে যে এলএনজি আমদানি করা হবে, তা দিয়ে যে উৎপাদন ও উন্নয়ন হবে, তার মাধ্যমেই মানুষের জীবনযাপন সহজ করার চেষ্টা করবেন।

গ্যাসের দাম কেন বাড়ানো হল, এদিন সংসদে ভাষণে সরকারের কাছে সেই প্রশ্নের উত্তর চেয়েছিলেন বিরোধীদলীয় উপনেতা রওশন এরশাদ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দাম বাড়ানোর প্রয়োজনটা কেন ছিল? গ্যাসের বর্ধিত ব্যয় নির্বাহের জন্য পেট্রোবাংলার কোম্পানিগুলো ১০২ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল। কারণ এলএনজি আমদানি, এটা খুব ব্যয়সাপেক্ষ। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন মূল্যায়নে দেখেছে, বর্ধিত ব্যয় নির্বাহের জন্য কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ দাম বৃদ্ধি করার প্রয়োজন ছিল। সেখানে আমরা কতটুকু দাম বৃদ্ধি করেছি?

“গ্রাহকদের আর্থিক চাপের বিষয়টা বিবেচনা করে কমিশন মাত্র ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ দাম বৃদ্ধি করেছে। অর্থাৎ ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যহার ৯ দশমিক ৮০ টাকা।”

শেখ হাসিনা জানান, পাইপলাইন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, সম্পূরক শুল্ক, আমদানি পর্যায়ে মূল্য সংযোজন করসহ আমদানি করা প্রতি ঘনমিটার এলএনজি সরবরাহ করতে ব্যয় হয় ৬১ দশমিক ১২ টাকা।

“অর্থাৎ ৬১ দশমিক ১২ টাকা দাম পড়ে। সেখানে আমরা নিচ্ছি মাত্র ৯ দশমিক ৮০। অর্থাৎ ৫১ দশমিক ৩২ টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।

“গ্রাহকদের আর্থিক চাপ যেন বেশি না পড়ে, সেজন্য সরকার থেকে ৭৯০৯ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা বা ভর্তুকি দেওয়া হবে। তাছাড়া জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল থেকে ২৪২০ কোটি টাকা প্রদান করা হবে।”

মিশ্রিত গ্যাসের মূল্য সহনীয় রাখার লক্ষ্যে ১৮ সেপ্টেম্বর হতে প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর সম্পূরক শুল্ক ৯৪ শতাংশ সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথাও জানান প্রধানমন্ত্রী।

“এজন্য সরকারের প্রায় ৯২০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় বন্ধ হয়ে যায়। এই রাজস্ব আদায় করতে পারলে আরও উন্নয়ন করতে পারতাম। কিন্তু মানুষের করা চিন্তা করেই সেটা আমরা করিনি। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে গ্যাসের মূল্যহার বৃদ্ধি না করে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি মেটানো হয়েছে।”

শেখ হাসিনা বলেন, “প্রতি বছরে আমাদের ১৯ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। সেটাও আমরা সব ট্যাক্স, শুল্ক বাদ দিয়ে দিয়েছি। এই টাকা আমাদের ভর্তুকি দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের ৩০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে।”

গ্যাস খাতের উন্নয়নে উত্তোলনের জন্য বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিসহ নানা পদক্ষেপের কথা বলেন তিনি। গত ১০ বছরে উত্তোলন বাড়িয়ে ১২৫০ ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর কথাও তিনি বলেন।

“আমরা এলএনজি আমদানি করছি গ্যাসের চাহিদা মেটানোর জন্য। আমাদের শিল্পায়ন হচ্ছে, চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু সেই পরিমাণ গ্যাস কিন্তু আমাদের দেশে নাই। আমরা কূপ খনন করছি। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে, সেটুকু উত্তোলন করা হচ্ছে। বিশাল সমুদ্রসীমা আমরা অর্জন করেছি। সেখানেও গ্যাস উত্তোলনের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি।”

১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য জ্বালানি দরকার মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “এই এলএনজি আমদানির কারণে জনজীবনে যেন বাড়তি চাপ না পড়ে, সেজন্য আমরা দেশীয় গ্যাসের সঙ্গে মিশ্রণ করে জাতীয় পাইপলাইনে সরবরাহের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি, সেজন্য মিশ্রিত গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটারে মাত্র ১২ দশমিক ৬০ টাকা ধরা হয়েছে।”

এলএনজি আমদানির জন্য বাংলাদেশে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার পরও অন্যান্য দেশের তুলনায় তা ‘অনেক কম’ বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।

“যারা বলছে, ভারত গ্যাসের দাম কমিয়েছে, তাদের কথা ঠিক না।”

ভারতে বিভিন্ন খাতের বাংলাদেশের চেয়ে যে গ্যাসের দাম বেশি, তার চিত্র তুলে ধরে তিনি।

বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের সময় বিভিন্ন খাতের উন্নয়নের কথা তুলে ধরে বলেন, “এই এক দশকে বাংলাদেশ একটা উন্নয়নের মহীসোপানে যাত্রা শুরু করেছে। আজকের বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের একটা রোল মডেল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।”

৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার ‘বিশাল’ বাজেট দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমাদের দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের বাজেটের শতকরা ৯৯ ভাগই নিজস্ব অর্থায়নে করতে পারি। এখন আর অন্যের কাছে আমাদের হাত পাততে হয় না।

“দেশের আমরা উন্নত করতে চায়। কারও কাছে হাত পেতে বা ভিক্ষা চেয়ে নয়। দেশের সম্পদ দিয়ে আমরা উন্নয়ন করব।”