গ্যাসের দাম: চুলায় বাড়লো ১৭৫ টাকা

সমাজের বিভিন্ন অংশের আপত্তির মধ্যেই সব পর্যায়ে গ্যাসের দাম গড়ে ৩২.৮ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার, যা কার্যকর হবে জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকেই।

নিজস্ব প্রতিবেদনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 June 2019, 10:57 AM
Updated : 7 July 2019, 01:53 PM

আবাসিক গ্রাহকদের এক চুলার জন্য মাসে ৯২৫ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ৯৭৫ টাকা দিতে হবে, যা এতোদিন ছিল যথাক্রমে ৭৫০ টাকা ও ৮০০ টাকা।

গৃহস্থালিতে মিটারে যারা গ্যাসের বিল দেন, তাদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের ব্যবহারের জন্য ১২ টাকা ৬০ পয়সা করে দিতে হবে। এতোদিন প্রতি ঘনমিটারে তাদের বিল হত ৯ টাকা ১০ পয়সা।

অর্থাৎ, রান্নার গ্যাসের জন্য চুলাভিত্তিক গ্রাহকদের প্রতি মাসে ২৩ শতাংশ এবং মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের ৩৮ শতাংশ বেশি অর্থ খরচ হবে।

যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম সোমবার থেকে প্রতি ঘনমিটারে ৩৮ টাকা থেকে বেড়ে ৪৩ টাকা হবে।

এই হিসাবে গাড়ির গ্যাসের জন্য মালিকদের খরচ বাড়বে সাড়ে ৭ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই গণপরিবহনে এর প্রভাব পড়বে; এর মাসুল দিতে হবে যাত্রীদের।  

পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার, শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ৩৫ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত।

এর ফলে শিল্পোৎপাদনে খরচ বাড়বে। আর ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে ক্রেতাদের কাছ থেকেই তা আদায় করবেন।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) রোববার বিকালে এক গণবিজ্ঞপ্তিতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর এই ঘোষণা দেয়।

বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম জানান, ভারিত গড়ে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৭ টাকা ৩৮ পয়সা থেকে ৩২.৮ শতাংশ বাড়িয়ে ৯ টাকা ৮০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় সেই তেল বিক্রি করে গত কয়েক বছর ধরেই লাভ পাচ্ছে সরকার। ফলে গ্যাস আর বিদ্যুতে ভর্তুকি দিতে হলেও সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে সরকারকে গত অর্থবছরে কোনো ভর্তুকি গুণতে হয়নি।  

তারপরও আমদানি করা তরলীকৃত প্রকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি জাতীয় গ্রিডে যোগ হওয়ায় যে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, তা সমন্বয় করতে এবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হল।

গ্যাসের দাম বাড়ল যে হারে

খাত

বর্তমান দাম

১ জুলাই থেকে

বাড়লো

গৃহস্থালি

মিটারভিত্তিক (প্রতি ঘনমিটার)

৯ টাকা ১০ পয়সা

১২ টাকা ৬০ পয়সা

৩৮%

এক বার্নার (প্রতি মাসে)

৭৫০ টাকা

৯২৫ টাকা

২৩%

দুই বার্নার (প্রতি মাসে)

৮০০ টাকা

৯৭৫ টাকা

২২%

যানবাহন (প্রতি ঘনমিটার)

সিএনজি (প্রতি ঘনমিটার)

৪০ টাকা

৪৩ টাকা

৭.৫%

বাণিজ্যিক (প্রতি ঘনমিটার)

হোটেল রেস্তোরাঁ

১৭ টাকা ০৪ পয়সা

২৩ টাকা

৩৫%

ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প

১৭ টাকা ০৪ পয়সা

১৭ টাকা ০৪ পয়সা

অপরিবর্তিত

অন্য খাতে (প্রতি ঘনমিটার)

বিদ্যুৎ

৩ টাকা ১৬ পয়সা

৪ টাকা ৪৫ পয়সা

৪১%

ক্যাপটিভ পাওয়ার

৯ টাকা ৬২ পয়সা

১৩ টাকা ৮৫ পয়সা

৪৪%

সার

২ টাকা ৭১ পয়সা

৪ টাকা ৪৫ পয়সা

৬৫%

শিল্প

৭ টাকা ৭৬ পয়সা

১০ টাকা ৭০ পয়সা

৩৮%

চা বাগান

৭ টাকা ৪২ পয়সা

১০ টাকা ৭০ পয়সা

৪৪%

বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম

খরচ বাড়াচ্ছে এলএনজি

বিইআরসির সদস্য মিজানুর রহমান বলেন, বর্তমানে প্রতিদিন ৬৫০ মিলিয়ন কিউবিক ফিট (এমএমসিএফডি) এলএনজি জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে। জুলাই মাস থেকে তা বেড়ে ৮৫০ এমএমসিএফডি হবে ধরে নিয়ে এই হারে মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। 

এক্ষেত্রে দেশে উত্তোলিত গ্যাসের গড় মূল্য দাঁড়াচ্ছে প্রতি ঘনমিটার ৫ টাকা এবং আমদানি করা এলএনজির ক্ষেত্রে ৩৫ টাকা।

মিজানুর বলেন, জুলাই থেকে সরবরাহ লাইনে ২৫০০ এমএমসিএফডি প্রাকৃতিক গ্যাস এবং ৮৫০ এমএমসিএফডি এলএনজি সঞ্চালন হবে বলে ধরা হয়েছে। তাতে প্রতি ঘনমিটারের খরচ বেড়ে গড়ে ১২ টাকা ৬০ পয়সা হবে। কিন্তু সরকার নেবে ৯ টাকা করে। বাকি টাকা বিভিন্ন খাত থেকে ভর্তুকি হিসেবে আসবে।

আগামী অর্থবছরে এলএনজির জন্য ১৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে জানিয়ে বিইআরসির এই সদস্য বলেন, এর মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে পাওয়া যাবে ৩৩ শতাংশ বা ৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। সরকারি কোষাগার থেকে আসবে ২৯ শতাংশ বা ৭ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল থেকে বাকি ২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা দেওয়া হবে। 

গণশুনানি থেকে গ্রাহক তাহলে কী পেল- এমন প্রশ্নের উত্তরে বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম বলেন, “গ্যাস সেক্টর একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল। বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন বিতরণ চ্যানেলে গ্যাস দেওয়া যাচ্ছিল না। এলএনজি আসার পর সেই সমস্যাটা কেটে যাচ্ছে।

“কস্ট অব এনার্জি এবং কস্ট অব নো এনার্জির হিসাবটা আপনাদের করতে হবে। তাহলে দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা বুঝতে সহজ হবে।”

তিনি বলেন, “আমরা একটা নতুন পথে যাত্রা শুরু করেছি। জাপানের মত দেশ ৮৫ শতাংশ জ্বালানি বিদেশ থেকে আমদানি করে চলছে। সেই দিক থেকে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও ভালো আছে।”

আপত্তি

সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১ মার্চ থেকে গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭০ শতাংশ বাড়িয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার। এলএনজি আমদানির প্রেক্ষাপটে বিতরণ কোম্পানিগুলো গতবছর আবাসিক ও বাণিজ্যিক সংযোগ বাদে অন্য ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করলেও নির্বাচনের আগে সরকার আর সেই প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি।

এরপর চলতি বছরের শুরুতে গ্যাসের দাম বাড়াতে আবার তোড়জোড় শুরু হয়। পেট্রোবাংলা এবং বিতরণ সংস্থাগুলোর প্রস্তাবের ওপর ১১ থেকে ১৪ মার্চ গণশুনানি করে বিইআরসি।

ওই শুনানির মধ্যেই ভোক্তা অধিকার সংগঠন, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক দলসহ সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগের বিরোধিতায় সরব হয়।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন- ক্যাবের এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাই কোর্ট থেকে বলা হয়, পেট্রোবাংলা ও তিতাসের দুর্নীতি ৫০ ভাগ কমালেই এলএনজি আমদানির কারণ দেখিয়ে গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে না।

তবে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গ্যাসের দাম সমন্বয়ের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, “গ্যাসের ভর্তুকিতে আমরা ১৪ হাজার কোটি টাকার মত ব্যয় করে ফেলেছি। এখন সামনে আরও ১৪ হাজার কোটি টাকা লাগবে। এই টাকাটা আসবে কোথা থেকে? গ্রাহকের কাছ থেকে তো আগের দামে সেই টাকা আসছে না। সুতরাং যদি সমন্বয় না করা হয়, সেক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেবে।”

বর্তমানে দেশে আবাসিক চুলার সংযোগ রয়েছে প্রায় ৩৮ লাখ। নির্দিষ্ট হারে মাসিক বিলের পরিবর্তে গ্যাসের চুলায় প্রিপেইড মিটার বসানোর কাজ চলছে। এরই মধ্যে দুই লাখ গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা হয়েছে।

দেশের সব আবাসিক গ্রাহককেই প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা হবে বলে সম্প্রতি প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন।