‘সেই টাকাতেও হাত দিল সরকার!’

সোমবার দুপুর ১টা; মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ভবনের নিচ তলায় কয়েক হাজার মানুষ; গম গম করছে পুরো ভবন; পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যাই বেশি; বেশিরভাগের বয়স ষাটের উপরে। কারও কারও আশিরও বেশি।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 June 2019, 06:26 PM
Updated : 24 June 2019, 06:31 PM

এরা সবাই এসেছেন সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকা তুলতে। সবার মধ্যেই এক ধরনের ক্ষোভ-হতাশা। চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ। কেননা, কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে? টাকা তুলতে পারবেন কি না, তার কোন নিশ্চয়তা নেই…

এদের একজন মুখলেছুর রহমান। অবসরপ্রাপ্ত এই সরকারি কর্মকর্তা থাকেন মিরপুর ডিওএইচএসে। অবসরের সময় পাওয়া টাকা নিয়ে পেনশনার সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন। তার মুনাফার টাকাই তুলতে এসেছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কী বিপদ রে বাবা! সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকা তুলে সংসার চালাতাম। সেই টাকাতেও হাত দিল সরকার! আবার শুনছি পহেলা জুলাইয়ের পর মুনাফা তুললে এতদিন যা পেতাম, তা পাব না। তাই আগের কয়েক মাসের মুনাফা এক সাথে তুলতে এসেছি।”

আরেক জন নাসিমা হক। স্বামী সৌদি আরবে থাকেন। দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে থাকেন যাত্রাবাড়ীতে। স্বামীর পাঠানো টাকা দিয়ে পারিবার সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন কয়েক বছর আগে।

নাসিমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুনাফা তুলে তুলে ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখাসহ অন্য খরচ করতাম। এখন কম টাকা পাওয়া গেলে কীভাবে চলব, সেটাই ভাবছি।”

নাসিমা জানালেন, আগামী ৩০ জুনের মধ্যে মুনাফা না তুললে ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ হারে কর কাটা হবে শুনে তিনি টাকা তুলতে এসেছেন।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত ১৩ জুন সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পর থেকেই মুখলেছুর রহমান ও নাসিমা হকের মতো অনেকে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা আগেভাগে তোলার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে ভিড় করছেন।

মতিঝিল অফিসের কর্মকর্তারা জানান, সঞ্চয়পত্র গ্রাহকদের সাধারণত দিনে ১০০০ থেকে ১২০০ টোকেন দেওয়া হত। তবে সোমবার প্রায় ৪ হাজার টোকেন দেওয়া হয়েছে।

এই গ্রাহকদের বেশিরভাগই মুনাফা তুলতে আসছেন। যারা বছরে একবার মুনাফা তোলেন, তারাই এখন বেশি আসছেন।

সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে সঞ্চয়পত্র বিক্রির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা রাত ৯টা পর্যন্ত সেবা দিয়েছেন। সব হিসাব-নিকাশ শেষ করে তাদের অফিস ছাড়তে রাত ১১টা বেজে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো পাশেই সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে নিচ তলাতেও ছিল একই রকম ভিড়।

সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ গ্রহণ বেড়ে যাওয়ায় সরকারের সুদব্যয়ের উপর বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। ব্যাংকের চেয়ে বেশি সুদহার থাকায় সঞ্চয়পত্রের দিকে মানুষের আগ্রহ বেশি।

সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর দাবি জানিয়ে আসছে ব্যাংকগুলো। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেসহ পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরাও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর দাবি জানাচ্ছে। তাদের দাবি, বেশি সুদ হওয়ায় সবাই সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে।

পুঁজিবাজারে মন্দাবস্থার এটা একটি কারণ বলে মনে করেন ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী।

বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বা সুদের হার এখন ১১ দশমিক শূন্য ৪ থেকে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ব্যাংকে আমানতের গড় সুদহার এখন ৬ শতাংশের মতো। মেয়াদি আমানতের সুদহার এর চেয়ে একটু বেশি।

বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৭৫ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এই সময়ে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি ছিল ৪৩ হাজার ৪৭৫কোটি টাকা।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার পুরো অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে যে পরিমাণ অর্থ ধার করার লক্ষ্য ধরেছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি নিয়ে ফেলে ১০ মাসেই।

সে হিসাবে বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৪৩ হাজার ৪৭৫কোটি টাকা টাকা ঋণ নেয়। অথচ গত বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণ বা ধার করার লক্ষ্য ঠিক করেছিল। পরে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৪৫ কোটি টাকা করা হয়।

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়।

বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

সঞ্চয়পত্র বিক্রির লাগাম টেনে ধরতে ২০১৫ সালের ১০ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ হার গড়ে ২ শতাংশ কমানো হয়েছিল, কিন্তু বিক্রি কমেনি।

এর পরেও দুই দফা সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কমানো হয়নি।

অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বলেন, “উৎসে করের হার বাড়িয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমানোর পক্ষে আমি নই। আমি মনে করি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ‘পেনশনার সঞ্চয়পত্র’ এবং মহিলাদের জন্য ‘পরিবার সঞ্চয়পত্র’ ছাড়া অন্য সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমালে বিক্রির চাপ অনেকটাই কমে আসবে।”

পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর কমানোর দাবি সংসদেও তুলেছেন সাবেক মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী।

তার মতে, গ্রামের বিধবা অনেক নারী সঞ্চয়পত্রের উপর নির্ভরশীল।

“ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হচ্ছে, গাড়ি কেনার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, সেখানে কেন অসহায়দের পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে হাত দিতে হল,” প্রশ্ন করেছেন মতিয়া।

বিক্রি কমাতে উৎসে কর বাড়ানোর পাশাপাশি গত মার্চ থেকে সঞ্চয়পত্রের সব ধরনের লেনদেন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আর এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন সনদ জমা দিতে হচ্ছে।।

অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেট পাস হলে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার উপর উৎসে কর ১০ শতাংশ হারে কাটা ১ জুলাই থেকে শুরু হবে।

তখন থেকে যারা নতুন সঞ্চয়পত্র কিনবেন, তাদের মুনাফা থেকে ১০ শতাংশ কেটে রাখা হবে। যারা আগের মাসগুলোর মুনাফা ১ জুলাইয়ের পর তুলবেন, তাদের কাছ থেকেও ১০ শতাংশ কর কাটা হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আয়কর অধ্যাদেশের নিয়ম এমনই যে যখন মুনাফার টাকা তোলা হবে, তখন যে হারে কর বলবৎ আছে, সেই হারেই কাটা হবে।

“যারা আগের মুনাফা ৩০ জুনের মধ্যে তুলবেন, তাদের ৫ শতাংশ কর কাটা হবে। আর যারা তুলবেন না, তাদের ১০ শতাংশ করে দিতে হবে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ৩০ জুনের মধ্যে মুনাফা না তুললে ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটা হবে- এমন খবরে তাদের ওপর ব্যাপক চাপ বেড়েছে। অনেক রাত পর্যন্ত কর্মকর্তাদের অফিস করতে হচ্ছে।

“আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।”

তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, উৎসে কর কাটার হার নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে অনেক, তাই এমনও হতে পারে অর্থবিল পাসের সময় সঞ্চয়পত্রের উপর থেকে ৫ বাড়তি উৎসে কর প্রত্যাহারও করে নিতে পারেন অর্থমন্ত্রী।