মুস্তফা কামালের ‘স্মার্ট’ বাজেট গতানুগতিক ছকেই

স্মার্ট বাজেট হবে, চমক হিসেবে থাকবে নতুন কিছু- অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রথম জাতীয় বাজেট দেওয়ার আগে আ হ ম মুস্তফা কামালের এমন কথায় ঔৎসুক্য তৈরি হলেও হতাশ হতে হয়েছে সবাইকে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 June 2019, 07:03 PM
Updated : 23 June 2019, 01:13 PM

২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ব্যয়ের যে ফর্দ বৃহস্পতিবার সংসদে হাজির করলেন তিনি, তাতে সেই ‘স্মার্টনেস’ কিংবা নতুনত্ব কিছুই পাওয়া যায়নি।

“এটি একটি ধারাবাহিক বাজেট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আগের দুটি সরকার টানা যে ১০টি বাজেট দিয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় নতুন বাজেট দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী,“ এই প্রতিক্রিয়া এল শেখ ফজলে ফাহিমের কাছ থেকে।

এফবিসিসিআই সভাপতির মতো সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্যও বাজেটে ‘নতুনত্ব’ খুঁজে না পাওয়ার কথা জানিয়ে বলেছেন, “এটা ধারাবাহিক বাজেট।”

বাজেট উত্থাপনের দুদিন আগে আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন মুস্তফা কামাল; জ্বর নিয়েই সংসদে এসে বাজেট বক্তৃতা শুরু করেছিলেন তিনি, কিন্তু তার কথায়ই অসুস্থতা টের পাওয়া যাচ্ছিল।

এক পর্যায়ে অর্থমন্ত্রীকে বিশ্রাম দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বাজেট বক্তৃতা উপস্থাপন শুরু করেন। এটা ছিল দেশবাসীর জন্য নতুন। সংসদে এর আগে কখনোই কোনো সরকার প্রধান বাজেট উপস্থাপন করেননি।

জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংসদে প্রবেশ করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ছবি: পিআইডি

টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের এটি একাদশ জাতীয় বাজেট হলেও এটি ছিল নতুন সরকারের নতুন অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেট; শিরোনামও দেওয়া হয়েছিল এরকম- ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ: সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’।

 কিন্তু নতুন সরকারের প্রথম বাজেট বক্তৃতায় এই অগ্রযাত্রার ভিত গড়ে আসার কথা বলা হলেও মেলেনি আগামী পাঁচ বছরে সামনে এগিয়ে চলার সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা।

দেবপ্রিয়ের ভাষ্যে, “বাজেট নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী হয়নি।”

২০৩০ সালের মধ্যে ৩ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্বকে নির্বাসনে পাঠানোর মতো গুটিকয়েক যে পরিকল্পনার কথা মুস্তফা কামাল বলেছেন বাজেট বক্তৃতায়, তা অর্জনের কোনো সুনির্দিষ্ট পথরেখা না দেখে পথ হারানোর শঙ্কাটিই সামনে আসছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই সময়ে সবচেয়ে আলোচিত যে ব্যাংক খাতের সঙ্কট ও খেলাপি ঋণ। তা নিয়ে বাজেট বক্তৃতায় অনেকটাই নিশ্চুপ ছিলেন অর্থমন্ত্রী, যা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।

দেবপ্রিয় বলেন, “ব্যাংকিং খাতের খারাপ অবস্থার কোনো স্বীকৃতি বাজেট বক্তব্যে ছিল না। ব্যাংকিং নিয়ে যা আছে, তা খুবই সামান্য।”

বিএনপি নেতা ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সমালোচনা আরও কড়া। তার দাবি, মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য প্রণীত হয়েছে এই বাজেট।

“তারা যে বাজেট দিয়েছে এবং যে ধরনের  অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এখন চলছে, এটা একটি শ্রেণির সুযোগ-সুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে এই বাজেট। আজকে বাজেট ব্যবস্থাপনাও একটা শ্রেণির কাছে কুক্ষিগত হয়ে গেছে।”

জায়েদ বখত

তবে বিষয়টি নিয়ে অনেকটা নমনীয় অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত। তিনি বলেন, “ব্যাংকিং খাতের উপর কিছু জেনারেল কথাবার্তা আছে, কিছু স্পেসিফিক কথাবার্তা আছে । ডিটেইলস নাই হয়ত কৌশলগত কারণে নেই অথবা বাজেটে এত কথা বলা যায় না।”

ব্যাংক খাতের সমস্যাটি বাজেট বক্তৃতায় বিস্তারিত আসতে পারত বলে মানছেন পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান খলীকুজ্জমান আহমদও।

“তবে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার কথা বলা হয়েছে, তারা হয়ত সমস্যার সমাধান করতে পারবে,” আশাবাদী তিনি।

খলীকুজ্জমানের কাছে ‘মোটামুটি ভালো’ এই বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ দিন হচ্ছে গ্রামে শহরের সুবিধা নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা, তরুণদের দক্ষতার উন্নয়ন, শিক্ষা ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে জোর দেওয়া।

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ

রেমিটেন্সে প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি চোখে লেগেছে অর্থনীতি গবেষক জায়েত বখতের।

“রেমিটেন্সের উপর যে নগদ প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে, সেটা নতুন এবং ভালো একটি বিষয়। অনেক দিন ধরে আলোচনা হচ্ছিল- যদি রপ্তানিকে প্রণোদনা দেওয়া যায়, রেমিটেন্সকে না কেন? এবার রেমিটেন্সকে নগদ ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, তাই বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ দেশে বাড়বে।”

মুস্তফা কামাল কথা দিয়ে রেখেছিলেন, নিজের প্রথম বাজেটে কর বাড়াবেন না তিনি। সরাসরি কর না বাড়িয়ে এক অর্থে কথা রেখেছেন তিনি।

তাহলে তিনি যে ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার ব্যয়ের ফর্দ তৈরি করেছেন, তার অর্থ সংস্থান কোত্থেকে হবে? যা কি না টাকার অঙ্কে বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেশি।

এই অর্থ সংস্থানে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটের উপরই ভর করতে চাইছেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টটেন্ট মুস্তফা কামাল। আবুল মাল আবদুল মুহিতের সময় নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন হলেও তা কার্যকর করা যায়নি, এবার তা কার্যকরে ব্যবসায়ীদের মানিয়েছেন নতুন অর্থমন্ত্রী।

 

সেই আশায় রাজস্ব আয়ের ৩৮ শতাংশই ভ্যাট থেকে আদায়ের ছক কষেছেন তিনি। আর ৩৫ শতাংশ খরচ আয়কর থেকে কোষাগারে ভরার পরিকল্পনা তার।

এটা করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী যে মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তদের পকেটে হাত দেবেন, সেটা তিনি নিজেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে এটাও বলেছেন, এক্ষেত্রে সতর্ক থাকবেন তিনি।

 

এ প্রসঙ্গে ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের অর্থমন্ত্রী জ্যঁ ব্যাপতিস্তা কোলবার্টের একটি উক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মুস্তফা কামাল বলেন, “রাজহাঁস থেকে পালক উঠাও যতটা সম্ভব ততটা। তবে সাবধান! রাজহাঁসটি যেন কোনোভাবেই ব্যথা না পায়।”

কয়েক মাস আগে তিনি এরকমই বলেছিলেন, ঋণ খেলাপি সবাইকে ধরে কারাগারে পাঠালে দেশ চলবে না।  

এবার ‘রাজহাঁস’ বা নিয়মিত করদাতাদের না ক্ষেপানোর প্রতিশ্রুতি দিলেন মুস্তফা কামাল।

হার না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা তুলে ধরে তিনি বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, “বর্তমানে যারা কর প্রদান করছেন, তাদের উপর করের বোঝা আর না বাড়িয়ে যারা কর প্রদান করছেন না বা করের আওতার বাইরে আছেন, তাদেরকে করজালে আনার উদ্যোগ নিয়েছি।”

বাজেটে কোন জিনিসের দাম বাড়ল, কোনটির কমল- সেদিকেই মূলত আগ্রহ থাকে সাধারণ মানুষের। বৃহস্পতিবার সংসদে অর্থমন্ত্রীর বাজেট উপস্থাপনের সময় ঢাকার স্টেডিয়াম মার্কেটের দোকানে টেলিভিশনে চোখ রাখেন অনেকেই। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে বাংলাদেশে এখন চার কোটি মানুষ মধ্য আয়ের গ্রুপে উঠে এসেছেন বলে হিসাব দেখিয়ে তাদের আয়করের আওতায় আনার লক্ষ্য ঠিক করেছেন তিনি। এজন্য প্রতিটি উপজেলায় আয়কর অফিস স্থাপন কর অঞ্চলের সংখ্যা ৩১টি থেকে বাড়িয়ে ৬৩টি করার পরিকল্পনা সাজিয়েছেন তিনি।

‘দ্রুততম সময়ের’ মধ্যে আয়কর দাতার সংখ্যা তিন গুণ বাড়িয়ে এক কোটিতে নেওয়ার ঘোষণা মুস্তফা কামাল দিলেও তা কীভাবে হবে, সেই প্রশ্নের উত্তর না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন কাজী খলীকুজ্জমান।

বিদায়ী অর্থবছরে আয়কর ও মুনাফার উপর কর আদায়ের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি বলে সংশোধিত বাজেটে তা ৯৫ হাজার ১৬৭ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। তারপরও এবার এখাতে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯১২ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার আশা করা হয়েছে।

বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ১ লাখ ৪ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

তারপরও এবারও সবচেয়ে বেশি কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে ভ্যাট থেকে, এক লাখ ২৩ হাজার ৬৭ কোটি টাকা।

তবে ভ্যাটের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে হার ১৫ শতাংশ হলেও নির্দিষ্ট পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ, সাড়ে ৭ শতাংশ ও ১০ শতাংশ হার কার্যকরের ঘোষণাসহ আইনে কিছু সংস্কারের প্রস্তাব করেছেন মন্ত্রী। এর ফলে ভ্যাট থেকে আদায় বাড়বে বলে ধরে নেওয়া যায়।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য

তারপরও বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখছেন সিপিডির দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য।

তিনি বলেন, “আগের বছরে কর সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি ২২ হাজার কোটি টাকা কমিয়েছেন, তবে আমাদের বিবেচনায় এটা প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে । তাহলে এবারের কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা কিন্তু বাস্তবসম্মত হল না।”

জায়েদ বখতও বলছেন, “দক্ষতা না বাড়ালে এই বড় বাজেট বাস্তবায়ন খুবই কঠিন হবে।”

কাজী খলীকুজ্জমানের পরামর্শ, “সরকারের উচিত হবে এত বড় বাজেট প্রথম থেকে বাস্তবায়নে মনোযোগ দেওয়া। রাজস্ব আহরণে জোর দিতে হবে।”

এক্ষেত্রে মুস্তফা কামাল ভরসা পেতে পারেন পূর্বসূরি মুহিতের কাছ থেকে; এক টানা ১০টি বাজেট দেওয়ার পর যিনি এখন রয়েছেন অবসরে।

টানা ১০টি বাজেট দেওয়ার পর এবার সংসদে দর্শক সারিতে বসে বাজেট বক্তৃতা শুনলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত

বৃহস্পতিবার সংসদে দর্শক হিসেবে বাজেট বক্তৃতা দেখার পর তিনি বিশাল বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, “হ্যাঁ, সম্ভব হতে পারে। আমাদের দেশে ট্যাক্স পেয়ার লোয়েস্ট, এটা যদি পরিবর্তন করতে পারে, বাড়ানো যায়, তাহলে হাইলি পসিবল।”

আরও খবর