‘লক্ষ্য পূরণের’ বাজেট নিয়ে আসছেন মুস্তফা কামাল  

সরকারের ভাবনায় আছে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন; আর অর্থমন্ত্রী চান, তার দেওয়া প্রথম বাজেট হবে ‘স্মার্ট’, যা হবে যথার্থভাবে বাস্তবায়নযোগ্য।  

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 June 2019, 03:25 PM
Updated : 12 June 2019, 03:59 PM

এই লক্ষ্য সামনে রেখে সোয়া পাঁচ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের ফর্দ সাজিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়নে জোর দেওয়া হবে এবারের বাজেটে। আয় বৈষম্য কমাতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নতুন উদ্যোগ থাকবে।  

দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের জন্য একাধিক স্তর সৃষ্টির নির্দেশনা থাকতে পারে এবার। প্রবাসী আয় ও তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বাজেটে থাকতে পারে প্রণোদনার সুখবর। 

অর্থমন্ত্রী আগেই জানিয়েছেন, নতুন বাজেটে তিনি কর হার বাড়াতে চান না। বরং করের আওতা বাড়িয়ে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে চান।  

তার বাজেট বক্তৃতার যে খসড়া এবার তৈরি করা হয়েছে, সেখানে আসন্ন নতুন অর্থবছরের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা।

সেক্ষেত্রে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার হবে আগের অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেশি।

খরচের যে হিসাব অর্থমন্ত্রী করেছেন তা হবে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৮.১ শতাংশের সমান।

অর্থমন্ত্রী হিসেবে এটাই হবে আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রথম বাজেট

মুস্তফা কামালের পূর্বসূরি আবুল মাল আবদুল মুহিত আওয়ামী লীগের ভোট সামনে রেখে বিদায়ী অর্থবছরে যে বাজেট দিয়েছিলেন, তার আকার ছিল ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা।

ওই অংক ছিল ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ২৫ শতাংশ বেশি এবং জিডিপির ১৮.৩ শতাংশের সমান।  

তবে অর্থবছর শেষে গত অর্থবছরের যে সংশোধিত বাজেট সংসদে তোলা হচ্ছে, তাতে মুহিতের দেওয়া ওই বাজেটের আকার নেমে আসছে চার লাখ ৪২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকায়।

সেই হিসাবে বলা যায়, বর্তমান অর্থমন্ত্রী কামাল বাজেটের আকার বাড়ালেও উচ্চাকাঙ্ক্ষী কোনো বড় পদক্ষেপ নিতে চাইছেন না। বরং আগের বাজেটের ধারাবাহিতা বজায় রেখে বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা সাজানোর দিকেই তার মনোযোগ। তার রাজস্ব আহরণের পরিকল্পনাতেও একই ইংগিত মেলে।  

কামাল আশা করছেন, নতুন অর্থবছরের সম্ভাব্য ব্যয়ের ৭২ শতাংশ তিনি রাজস্ব খাত থেকে পাবেন। তার প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হচ্ছে তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা।

সেক্ষেত্রে এই অংক হবে বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ১৯ শতাংশের বেশি।

মুহিত তার শেষ বাজেটে তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন। ওই অংক ছিল তার আগের বছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের ২৫ শতাংশ বেশি।

তবে সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ কমে তিন লাখ ১৬ হাজার ৬১২ কোটি টাকা হচ্ছে।

মুস্তফা কামালের পরিকল্পনায় আয় ও ব্যয়ের ঘাটতি থাকবে প্রায় এক লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশের সমান। অর্থনীতিবিদরা বাজেট ঘাটতির এই এই পরিমাণকে গ্রহণযোগ্য সীমার মধ্যেই ধরেন।

বিদেশ থেকে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ঋণ করে এই ঘাটতি মেটানোর পরিকল্পনা সাজিয়েছেন কামাল।

তিনি আশা করছেন, এই বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারলে মূল্যস্ফীতি ৫.৫ শতাংশের মধ্যে আটকে রেখেই ৮.২০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব হবে।

আ হ ম মুস্তফা কামালের পূর্বসূরি আবুল মাল আবদুল মুহিত গত এক দশকে টানা দশটি বাজেট দিয়েছেন

‘সমৃদ্ধির সোপান’

স্বাধীন বাংলাদেশে তাজউদ্দিন আহমেদ ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে ১৯৭২ সালে যে যাত্রার সূচনা করেছিলেন, সেই পথ ধরে বাংলাদেশের ৪৮তম বাজেট নিয়ে আসছেন আ হ ম মুস্তফা কামাল।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের শিরোনাম ছিল ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ‘। আর এবারের বাজেটের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ: সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’।

বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের এখন সহনীয় মাত্রায় আছে। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বাণিজ্যের জন্য অনুকূল পরিবেশ দিচ্ছে। মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক আছে ইতিবাচক ধারায়।

এসব বিষয়ে স্বস্তি থাকলেও অর্থনৈতিক সংস্কার, ব্যাংক খাতের সুশাসন, পুঞ্জিভূত খেলাপি ঋণ, বাড়তে থাকা আয় বৈষম্য, পুঁজিবাজারে আস্থার সঙ্কটের মত চ্যালেঞ্জ থাকবে মুস্তফা কামালের সামনে।       

বৃহস্পতিবার বেলা ৩টায় জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরবেন অর্থমন্ত্রী; তা পাস হবে ৩০ জুন। নতুন অর্থবছরের প্রথম দিন ১ জুলাই থেকে তা কার্যকর হবে।

মুস্তফা কামাল তার প্রথম বাজেট নিয়ে আগেভাগে কিছু জানাতে চাননি সাংবাদিকদের। নতুন বাজেটের ‘মজা’ পাওয়ার জন্য সংসদে বাজেট উপস্থাপন পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।  

চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সির ডিগ্রিধারী এই ব্যবসায়ী বলেছিলেন, বাজেট প্রণয়নে কোনো চ্যালেঞ্জ নেই, চ্যালেঞ্জ যা আছে তা বাস্তবায়নে।

তবে বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য শামসুল আলমের সঙ্গে কথা বলে এবারের বাজেট দর্শনের কিছুটা আভাস পাওয়া গেছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, নির্বাচনী ইশতেহার মাথায় রেখেই নতুন বাজেটের খসড়া তৈরি করা হয়েছে।অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয় বৈষম্য বড় হচ্ছে। সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে, আবার ব্যয়ও বৃদ্ধি করতে হবে।

“এসব বিবেচনায় নতুন বাজেটে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ দর্শন সামনে রাখা হচ্ছে। এটা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেই আছে। এর আওতায় দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বেশকিছু কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে।”

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট সাত লাখ কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের। ওই সময়ের মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে নিয়ে যেতে চায় তারা।

নতুন বাজেটের পরিকল্পনা করার সময় এ বিষয়গুলোও বিবেচনায় রাখা হয়েছে বলে জানান শামসুল আলম।

অর্থনীতির গবেষক জায়েদ মনে করেন, বিনিয়োগ বাড়াতে এবারের বাজেটে ‘সাহসী’ কিছু পদক্ষেপ থাকা উচিৎ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কিন্তু বাড়েনি; যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।”

এপ্রিল শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১২ শতাংশ। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে এই হার ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ হবে বলে ধরা হয়েছিল।

অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, “এতেই প্রমাণিত হয় যে দেশে বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটেনি। তাছাড়া খেলাপি ঋণ কমিয়ে এনে ব্যাংক খাতের সুশাসন নিশ্চিত করাও এখন জরুরি।”

যা ছিল, যা হচ্ছে

 

২০১৮-১৯ (মূল বাজেট)

২০১৮-১৯ (সংশোধিত)

২০১৯-২০ (প্রস্তারিত)

মোট ব্যয়

৪৬৪৫৭৩ কোটি টাকা

৪৪২৫৪১ কোটি টাকা

৫২৩১৯০ কোটি টাকা

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)

১৭৩০০০ কোটি টাকা

১৬৭০০০ কোটি টাকা

২০২৭২১ কোটি টাকা

 

 

 

 

মোট আয়

৩৩৯২৮০ কোটি টাকা

৩১৬৬১২ কোটি টাকা

৩৭৭৮১০ কোটি টাকা

এনবিআর নিয়ন্ত্রিত কর

২৯৬২০১ কোটি টাকা

২৮০০০০ কোটি টাকা

৩২৫৬০০ কোটি টাকা

এনবিআর বহির্ভূত কর

৯৭২৭ কোটি টাকা

৯৬০০ কোটি টাকা

১৪৫০০ কোটি টাকা

কর বহির্ভূত রাজস্ব

৩৩৩৫২ কোটি টাকা

২৭০০০ কোটি টাকা

৩৭৭১০ কোটি টাকা

 

 

 

 

ঘাটতি

১২১২৪২ কোটি টাকা

১২২১৪২ কোটি টাকা

১৪৫৩৮০ কোটি টাকা

ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে ঋণ

৫০০১৬ কোটি টাকা

৪৩৩৯৭ কোটি টাকা

৬৩৮৪৮ কোটি টাকা

অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ

৭১২২৬ কোটি টাকা

৭৮৭৪৫ কোটি টাকা

৭৭৩৬৩ কোটি টাকা

ব্যাংক থেকে ঋণ

৪২০২৯ কোটি টাকা

৩০৮৯৫ কোটি টাকা

৪৭৩৬৪ কোটি টাকা

সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ

২৬১৯৭ কোটি টাকা

৪৫ হাজার কোটি টাকা

২৭০০০ কোটি টাকা

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট

সংশোধিত বাজেট

বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বেশ কাটছাঁট করা হয়েছে এবার।বৃহস্পতিবার নতুন অর্থবছরের বাজেটের সঙ্গেই তা সংসদে তোলা হবে।

বিদায়ী অর্থবছরে মূল বাজেটের আকার ছিল চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমে চার লাখ ৪২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা হচ্ছে। অর্থাৎ, ব্যয়ের পরিমাণ কমেছে ২২ হাজার ৩২ কোটি টাকা।

মূল বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমে তিন লাখ ১৬ হাজার ৬১২ কোটি টাকা হচ্ছে।

এডিপির পরিমাণ মূল বাজেটে ছিল এক লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে তা পাস হয়েছে।

মূল বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল এক লাখ ২১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে এক লাখ ২২ হাজার ১৪২ কোটি টাকা হচ্ছে।