৯ বছরেও শেষ হয়নি বেসিক কেলেঙ্কারির তদন্ত

নয় বছর সময় নিয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত চালিয়েও রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির ৫৬ মামলার কোনোটিতে অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারেনি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

তাবারুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2019, 06:36 PM
Updated : 7 June 2019, 06:36 PM

২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি আবদুল হাই বাচ্চু। আর তখনই ব্যাংকটির দিলকুশা, গুলশান ও শান্তিনগর শাখা থেকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে কয়েক হাজার কোটি টাকা উত্তোলন ও আত্মসাতের ঘটনা ঘটে।

ঋণপত্র যাচাই না করে জামানত ছাড়া জাল দলিলে ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়াসহ নিয়ম না মেনে ‍ঋণ অনুমোদনের অভিযোগ ওঠে তখনকার পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে।

এ বিষয়ে ২০১০ সালে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। প্রায় চার বছর অনুসন্ধান শেষে ২০১৫ সালে রাজধানীর তিনটি থানায় ১৫৬ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে কমিশন।

সেসব মামলার আসামির তালিকায় ২৬ জন ব্যাংক কর্মকর্তা থাকলেও বাচ্চু বা পরিচালনা পর্ষদের কাউকে সেখানে না রাখায় প্রশ্ন ওঠে সে সময়।

এরপর বিভিন্ন মহলের সমালোচনা এবং উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে পাঁচ দফা বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক।

দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে শেখ আবদুল হাই বাচ্চু (ফাইল ছবি)

২০১৬ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রথম জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর আগে সংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাচ্চু শুধু বলেছিলেন, “নিজেকে দোষী মনে করি না।”

আর ওই দিনই জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “যে অভিযোগগুলো নিয়ে দুদক তদন্তের মধ্যে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, সেগুলোর উত্তর দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে আমি দুদককে আরও সহযোগিতা করব। যেটুকু আমার পক্ষে সম্ভব, তা দিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদের কয়েক দিন আগে বেসিক ব্যাংকের সাবেক ১০ পরিচালককেও জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। তারা সবাই বাচ্চুর নেতৃত্বে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন।

এরপর কেটে যায় আরও প্রায় আড়াই বছর। বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি মামলার এক আসামি জামিনের জন্য হাই কোর্টে যান। এত বছরেও মামলাগুলোর তদন্ত শেষ না হওয়ায় ১০ তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করে হাই কোর্ট।

গত বছরের ৩০ মে তদন্ত কর্মকর্তারা আদালতে উপস্থিত হলে ক্ষোভ, উষ্মা ও হতাশা প্রকাশ করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাই কোর্ট বেঞ্চ।

এর আগে ২০১৭ সালের ৩১ মার্চ দুদকের প্রধান কার্যালয়ে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমন্বিত প্রয়াস’ শীর্ষক এক সেমিনারে বিষয়টি তোলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান।

জবাবে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ তখন বলেছিলেন, “মাঝে মাঝে আমার কষ্ট হয় যে, শুধু বেসিক ব্যাংক কেন, এমন কোনো ব্যাংক নেই যে জনগণের অর্থ তসরুপ করেনি। চার হাজার কোটি টাকা দেখলেন শুধু বেসিক ব্যাংকে। ১২ হাজার, ২০ হাজার কোটি টাকা কোথায় গেল? পত্রিকায় একটি রিপোর্ট এসেছে, এক লাখ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে কোথায় গেছে? এখন বেসিক ব্যাংককে নিয়ে প্রশ্ন করা হয়।

“বার বার বলছি, প্লিজ ওয়েট অ্যান্ড সি, আমাদের সময় দেন। শুধু বেসিক ব্যাংক নয়, গত এক বছরে চেষ্টা করেছি সব ব্যাংক নিয়ে। বেসিক ব্যাংকের বিষয়ে ৫৬টি মামলা হয়েছে। কিন্তু একটি মামলারও অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি, সেটা আমাদের ব্যর্থতা।”

আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর আরেকটি মামলা করে দুদক।

রাজধানীর বংশাল থানায় দায়ের করা ওই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে সাত কোটি ৮৫ লাখ ৩২ হাজার ৯৮৮ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।

২০১০ সালের ২৯ মার্চ থেকে ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবরের মধ্যে এই অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটলেও সেখানেও বাচ্চুকে আসামি করা হয়নি।

এদিকে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের কৌশলপত্র-২০১৯ নিয়ে ‘সুশীল সমাজের’ প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।

দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সেদিন বলেন, “বেসিক ব্যাংকের ৫৬টি মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আরও মামলা হতে পারে। ব্যাংকার, ব্যবসায়ী যারা আসামি তারাও দ্রুত মামলার চার্জশিট চান। আমরা চেষ্টা করছি। ব্যাংকের টাকাটা কিন্তু জনগণের। জনগণের টাকা ব্যাংকে ফিরে আসুক, এটা কিন্ত জনগণ চায়।”

বেসিক ব্যাংকের ওই সব ঋণের মধ্যে দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে নগদ জমা হওয়ার তথ্যও সে সময় দিয়েছিলেন তিনি।

“কমিশনের মামলার কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতে চুরি হওয়া কয়েক হাজার কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে। আমরা অপরাধীদের পেছনে নিরবচ্ছিন্নভাবে আইনি অভিযান অব্যাহত রাখব। কাউকেই ছাড় দেব না,” বলেছিলেন দুদক চেয়ারম্যান।

এরপর গত ১৩ মে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদন দিয়ে বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে আসার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন ইকবাল মাহমুদ।

বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির তদন্ত শেষ না হওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “এই কথাটা গত দুই বছর ধরে শুনে আসছি। বেসিক ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক… আর ব্যাংক নেই বাংলাদেশে?

“টাকা কোথায় গেল, তা যদি আমি কোর্টে না বলতে পারি তাহলে তো কোনো কেইসই না। আমাদের উদ্দেশ্য হল, এই টাকা কোথায় গেল, তা প্রমাণ করা।”

ব্যাংকগুলোকে আইন মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আইন-কানুন মানা হলে দুদক কখনও হস্তক্ষেপ করবে না।”

বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুদকের করা ৫৬ মামলার ১০ জন তদন্ত কর্মকর্তার কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

এসব মামলা তদন্তের তদারক কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেশ কিছু মামলার তদন্ত কাজ শেষ পর্যায়ে। আমরা অন্যান্য মামলার তদন্ত কাজও এগিয়ে নিয়েছি। এখন তদন্তের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নতুন করে দেখা হচ্ছে। আশা করছি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেওয়া সম্ভব হবে।”