রপ্তানি আয়ে ধীরগতি

তৈরি পোশাকের উপর ভর করে রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ। তবে চামড়া, হিমায়িত চিংড়ি এবং পাট পণ্যের রপ্তানি কমায় সামগ্রিক রপ্তানির অগ্রযাত্রায় কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে।

আবদুর রহিম হারমাছিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 May 2019, 12:32 PM
Updated : 9 May 2019, 01:40 PM

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বৃহস্পতিবার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, গত কয়েক মাস ধরে রপ্তানি আয়ে বেশ ভালো প্রবৃদ্ধি হলেও মে মাসে এসে তা কমে গেছে। এই মাসে মাত্র ২ দশমিক ৬৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে; লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।

মে মাসে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৩০৩ কোটি ৪২ লাখ ডলার আয় করেছে। লক্ষ্য ছিল ৩০৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের। এ হিসাবে লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ১ দশমিক ৫২ শতাংশ।

তবে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের দশ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) হিসাবে মোটামুটি ভালো প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। এই দশ মাসে ৩ হাজার ৩৯৩ কোটি ৭৩ লাখ (৩৩.৯৪ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানির এই অংক গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি।

জুলাই-এপ্রিল সময়ে মোট রপ্তানির লক্ষ্য ধরা ছিল ৩ হাজার ১৯০ কোটি ৯০ লাখ (৩১.৯০ বিলিয়ন) ডলার। গত অর্থবছরে এই দশ মাসে আয় হয়েছিল ৩ হাজার ৪০ কোটি ৬৪ লাখ (৩০.৪০ বিলিয়ন) ডলার।

তবে এই প্রবৃদ্ধিতে মোটেই খুশি হন পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনামে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১. দশমিক ৭৫শতাংশ। সেখানে আমাদের পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে অর্ধেকেরও কম; ৫ দশমিক ৭ শতাংশ।

“এর প্রধান কারণ হচ্ছে আমরা আমাদের পোশাকের ন্যায্য দাম পাচ্ছি না। বেশি পোশাক রপ্তানি করে কম আয় করছি। এখানে আমাদের পোশাক রপ্তানিকারকরাও এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা করে কম দামে অর্ডার নিচ্ছে। বায়ারাও এই সুযোগ নিয়ে কম তামে পোশাক কিনছে।”

“আমাদের এখন পোশাকের দাম বাড়ানোর দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার, মালিক এবং শ্রমিক সবাই মিলে এক সাথে কাজ করতে হবে।”

“তানাহলে এখন যে ১১/১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সেটাও ভবিষ্যতে থাকবে না।”

ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র বিদায়ী সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন মনে করেন, বর্তমানে বাংলাদেশের যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তা সন্তোষজনক। এই ধারা অব্যাহত থাকলে প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এর পেছনেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

ব্যাংক ঋণের অধিক সুদ হার এবং বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য কমে যাওয়ার বিপরীতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে গিয়ে অনেক ব্যবসায়ী ‘অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ছেন’ দাবি করে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি মহিউদ্দিন বলেন, এজন্য সরকারকে ব্যবসা ও বিভিন্ন খাতের প্রতি আরও যত্নবান হতে হবে। কেবল দুয়েকটি পণ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে রপ্তানি পণ্য তালিকায় নতুন নতুন পণ্য যোগ করতে হবে। একইসঙ্গে নতুন বাজারও খুজে বের করতে হবে।

পোশাক খাত

রপ্তানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ২ হাজার ৮৪৯ কোটি ৭ লাখ (২৮.৪৯ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। যা মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ।

এই দশ মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ।

জুলাই-এপ্রিল সময়ে নিট পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৪০৮ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ। উভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৪৪০ কোটি ৫৭ লাখ ডলার: প্রবৃদ্ধি ১২ দশমিক ৮৫ শতাংশ।  

চামড়াজাত পণ্য

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি আয়ের উৎস চামড়া শিল্পের খরা আরও প্রকট হয়েছে। অর্থবছরের দশ মাস পার হলেও ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির ধারা থেকে বের হতে পারেনি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের এই খাত।

জুলাই-এপ্রিল সময়ে এ খাতের রপ্তানি আয় কমেছে ৮দশমিক ৬৯ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ৯ শতাংশ। এ সময়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ৮৩  কোটি ৭১ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই খাত থেকে আয় হয়েছিল ৯১ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। লক্ষ্য ধরা ছিল ৯১ কোটি ৯৬ লাখ ডলার।

বাংলাদেশ লেদার ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার গুডস ইন্টারন্যাশনাল সোর্সিং শো ব্লেইজে প্রদর্শিত বিভিন্ন ধরনের আধুনিক যন্ত্রাংশ। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গোটা বিশ্বব্যাপীই এখন চামড়া শিল্পের খারাপ সময় যাচ্ছে। তারই প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে সেটাই চামড়াজাত পণ্যের বাজারকে খারাপ করে দিয়েছে।

“চীন বাংলাদেশ থেকে ফিনিস লেদার আমদানি করে তা দিয়ে পণ্য তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র রপ্তানি করত। বর্তমানে এই প্রক্রিয়া কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ট্রেড ওয়্যারের কারণে।”

এছাড়া হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরী স্থানান্তর এই পণ্যের রপ্তানি কমে যাওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন তিনি।

“সাভারে যাওয়ার পর অবকাঠামোগত নানা জটিলতায় পড়েছে এই শিল্প। তবে সরকারকে বর্তমানে সিরিয়াস মনে হচ্ছে। তাই অচিরেই দেশীয় সমস্যা কেটে যাবে বলে আমরা আশা করি,” বলেন তিনি।

পাট পণ্য

চলতি অর্থ বছরের প্রথম দশ মাসে ৬৯ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮৮ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। এ হিসাবে এই খাতেও দেখা দিয়েছে ২১ দশমিক ৮৩ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি।

হিমায়িত চিংড়ি

জুলাই-এপ্রিল সময়ে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৩১ কোটি ৮৪ লাখ ডলার আয় করেছে। রপ্তানির এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ৩৮ শতাংশ কম।

এই দশ মাসে এ খাতের লক্ষ্য ছিল ৩২ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে আয় হয়েছিল ৩৫ কোটি ৫৩ লাখ ডলার।

কৃষিপণ্য

তবে কৃষি পণ্য রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। জুলাই-এপ্রিল সময়ে বিভিন্ন কৃষি পণ্য রপ্তানি থেকে ৭৯ কোটি ডলার আয় হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৫ দশমিক ৬১ শতাং বেশি। লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেড়েছে ৩৭ শতাংশ।

এই দশ মাসে শাক-সবজি রপ্তানিতে ৩৮ দশমিক ৫২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তামাক রপ্তানি বেড়েছে ৮ শতাংশ। শুকনা খাবার রপ্তানি ২০ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেড়েছে। চা রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ২২ শতাংশ।

ওষুধ

জুলাই-এপ্রিল সময়ে ওষুধ রপ্তানিতে ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেড়েছে ২১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

এ সময়ে ১১ কোটি ১৭ লাখ ডলারের ওষুধ রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরের এই দশ মাসে আয় হয়েছিল ৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এ সময়ে রপ্তানির লক্ষ্য ধরা ছিল ৯ কোটি ১৮ লাখ ডলার।