প্রবৃদ্ধির হিসাব নিয়ে সন্দেহ সানেমের

চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ হওয়ার যে আভাস সরকার দিচ্ছে, তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 May 2019, 12:10 PM
Updated : 9 May 2019, 12:15 PM

সরকারের কথার সঙ্গে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলোর তথ্য-উপাত্ত মেলে না দাবি করে তারা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সরবরাহ করা তথ্য-উপাত্তগুলো পুনঃপর্যালোচনার আহ্বান জানিয়েছে।

এর আগে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডিও সরকারের প্রবৃদ্ধির হিসাব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল।

গত জানুয়ারিতে টানা তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়া আওয়ামী লীগ সরকার চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ হবে বলে ধরেছে।

সরকারের এই প্রাক্কলনের কাছাকাছি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের আভাস দিয়েছে এডিবি; তারা বলছে এই অঙ্ক ৮ শতাংশ হতে পারে। তবে বিশ্ব ব্যাংক বলছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ।

বৃহস্পতিবার সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত ‘কোয়ার্টারলি রিভিউ অফ বাংলাদেশ ইকোনমি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে সরকারের প্রবৃদ্ধির হিসাব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে রপ্তানি, রেমিটেন্স ও বিদেশি বিনিয়োগ।

“বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশে এখন রপ্তানি, রেমিটেন্স ও বিদেশি বিনিয়োগের চেয়েও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি প্রবৃদ্ধির গতি বাড়াচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি কম আয়ের দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি দিয়ে বড় ধরনের প্রবৃ্দ্ধি হতে পারে না।”

তিনি চীনের প্রবৃদ্ধির উদাহরণ দিয়ে বলেন, দেশটিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে। তার একটি বড় কারণ হচ্ছে তারা বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করেছে।

“এজন্য তার গ্রোথ কমে যাচ্ছে, তাকে গ্রোথ স্যাক্রিফাইস করতে হচ্ছে,” বলেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা এ ধরনের একটা ব্যখ্যা দিতে চাইলে সেই ব্যাখ্যাটি কিন্তু বিপজ্জনক। কারণ বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় অনেক কম। এত কম মাথাপিছু আয়ের দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা দিয়ে এধরনের প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়।”

সেলিম রায়হান বলেন, ১৯৮০ সালে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বের যেসব দেশ বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, সেসব দেশে অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখেছিল রপ্তানি।

তিনি বলেন, “তাহলে আমাদের যে প্রবৃদ্ধি, ধরে নিচ্ছি তা হচ্ছে বহির্বাণিজ্য দিয়ে, বিশেষ করে এক্সপোর্ট ও রেমিটেন্স। অথচ দেখছি সম্প্রতি রেমিটেন্স ও রপ্তানিতে নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধির প্রবণতা। অথচ প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী হতে দেখা যাচ্ছে।”

“তাহলে আমরা কীভাবে এই ঊর্ধ্বমুখী জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ব্যাখ্যা করবো? একাডেমিক ও পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে আমরা এই প্রবৃদ্ধিকে ব্যাখ্যা করতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি।”

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য কেন পুনঃপর্যালোচনার প্রয়োজন, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ৫টি উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন সেলিম রায়হান।

প্রথম উদ্বেগটি হচ্ছে রপ্তানি ও রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি কমার পরেও অভ্যন্তরীণ চাহিদার উচ্চ প্রবৃদ্ধি।

সেলিম রায়হান বলেন, “বিবিএস বেসরকারি ব্যয়ের হিসাবে দেখিয়েছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৪৩ ভাগ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এখাতের প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে ১১ দশমিক ০২ শতাংশ। অর্থনীতিবিদের মতে এটা অস্বাভাবিক।

“কারণ আমরা আগের বছরগুলোতে এত প্রবৃদ্ধি দেখি না। যেমন ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এখাতের প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশ আর ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ১ শতাংশ। কিন্তু প্রাইভেট সেক্টরের ব্যয়ে এত উচ্চ প্রবৃদ্ধি কেন হল, তা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না।”

সরকারি ব্যয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধি ব্যাখ্যা করা গেলেও ‘প্রাইভেট কনজামশন একটি পাজল’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

দ্বিতীয় উদ্বেগটি হচ্ছে- চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাবে শিল্প উৎপাদনে উচ্চ প্রবৃদ্ধি। শিল্প উৎপাদন প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ। অথচ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এখাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৯৭ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরে কম রপ্তানি প্রবৃদ্ধি এবং ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ কম হওয়ার পরও কীভাবে এত প্রবৃদ্ধি, তাও মেলাতে পারছে না সানেম।

তৃতীয় উদ্বেগটি হচ্ছে- দুর্বল বাণিজ্যিক পরিবেশের মধ্যেও উচ্চ শিল্প উৎপাদনে এত বেশি প্রবৃদ্ধি কীভাবে সম্ভব হল?

সেলিম রায়হান বলেন, “কারণ ২০১৮ সালে ব্যবসাসহজীকরণ সূচকে আমরা পিছিয়েছি। ১৭৪ থেকে ১৭৬ নম্বর হয়ে ২ ধাপ পিছিয়েছি। একইভাবে লজিস্টিকস পারফরমেন্স সূচকেও বাংলাদেশ ৮৭ থেকে ১০০তম হয়ে ব্যাপকভাবে পিছিয়ে গেছে।”

চতুর্থ উদ্বেগটি হচ্ছে- কম বিনিয়োগ দিয়ে শিল্প উৎপাদন প্রবৃদ্ধি বেশি হওয়া।

এত দুর্বল ব্যবসাবান্ধব পরিবেশে কীভাবে কম বিনিয়োগ দিয়ে বেশি উৎপাদন হয়, এটা আরেকটা ‘পাজল’ সেলিম রায়হানের কাছে।

পঞ্চম উদ্বেগটি হচ্ছে- প্রবৃদ্ধির মান। বেশি প্রবৃদ্ধি দিয়েও দারিদ্র্য কমার প্রবণতা কম। 

সেলিম রায়হান বলেন, ২০১০ সালে প্রবৃদ্ধি আরও কম হলেও দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ হারে। কিন্তু এরপর থেকে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও দারিদ্র্যহার কমার প্রবণতা কমছে। যেমন ২০১৬ সালে দারিদ্র্য বিমোচন হার ছিল ১ দশমিক ২ শতাংশ।

তিনি এই ‘মানহীন প্রবৃদ্ধির’ কারণে বৈষম্য ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ার বিষয়টি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক বাংলাদেশে জিডিপির বিপরীতে কর আদায় হার অন্য দেশগুলোর তুলনায় খুব কম উল্লেখ করে এ খাতের উন্নয়নের পরামর্শ দেন।

সানেম চেয়ারম্যান অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকার বলেন, “আমাদের রাজস্ব বাড়ানোর কোনও বিকল্প নেই। এ জন্য নতুন খাত বের করতে হবে।”

ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে সানেম।

ঢাকার মহাখালীর ব্র্যাক ইন সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এ আলোচনায় সানেমের গবেষণা পরিচালক সায়মা হক বিদিশাও বক্তব্য রাখেন।