ঋণ খেলাপি সবাইকে জেলে পাঠালে দেশ চলবে না: অর্থমন্ত্রী

ব্যবসায় উত্থান-পতনের কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যারা ঋণ খেলাপি হন, তাদের রক্ষায় ব্যাংক ব্যবস্থায় কিছু সংস্কার আনতে চান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2019, 04:38 PM
Updated : 25 April 2019, 05:25 PM

“ঋণ খেলাপি হলেই যদি সব ব্যবসায়ীকে জেলে পাঠানো হয়, তাহলে দেশ চলবে না,” বলেছেন তিনি।

ঢাকার শেরে বাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে বৃহস্পতিবার এক প্রাক বাজেট আলোচনায় একথা বলেন অর্থমন্ত্রী।

চার মাস আগে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর খেলাপি ঋণ কমানোর ঘোষণা দেন মুস্তফা কামাল। এরপর ঋণ খেলাপি তকমা থেকে অনেকের বেরিয়ে আসার কিছু সুযোগ করে দেওয়া হয়।

বৃহস্পতিবারের আলোচনায় তিনি বলেন, “ব্যবসা করতে গেলে যেমন আয়ের সম্ভাবনা থাকে, তেমনি লোকসানের সম্ভাবনাও আপনি উড়িয়ে দিতে পারেন না। কিন্তু যারা লোকসান দেয়, তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা রাখা হয় নাই।

“ব্যাংকিং খাতে একটি করুন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংকে যদি একবার কোনো কারণে ঋণ গ্রহীতা হন, তাহলে সেখান থেকে বের হওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।”

মুস্তফা কামাল যুক্তরাজ্যের একটি সময়ের উদাহরণ টেনে বলেন, “১৮৬৯ সালের আগে ইংল্যান্ডেও ‘ইনসলভেন্সি অ্যাক্ট’ ছিল না। সে কারণে সেই সময়ে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের মোট ২০ হাজার লোক জেলে ছিল। এর মধ্যে ১০ হাজারই ছিল ঋণ খেলাপি।”

বাংলাদেশে এখনও সেই সুযোগ না থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমাদের এখানে ইনসলভেন্সি অ্যাক্ট নেই, আরবিট্রেশনের ব্যবস্থা নেই, দেউলিয়া আইন নেই।

“ইংল্যান্ডের ইনসলভেন্সি অ্যাক্ট করা হয়েছিল যারা জেলে ছিল তাদেরকে বের করার জন্য। এখন আমরাও এধরনের কিছু কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছি।”

‘ভালো’ উদ্যোক্তা যারা ঋণ খেলাপি হয়েছেন, তাদের জন্য উদ্যোগ নেবেন জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমরা ব্যাংক এবং আর্থিক খাতে কিছু সংস্কার করতে চাই।”

ব্যাংক ঋণে সুদের হার কমালে তা শিল্পায়নের পাশাপাশি ঋণ খেলাপি কমাতে ভূমিকা রাখবে বলেও মনে করেন মুস্তফা কামাল।

“পৃথিবীর কোনো দেশে ১৭/১৮ শতাংশ সুদ নেই। এত সুদ দিয়ে কোনো শিল্প টিকতে পারে না। সুদহারও অনেক কমাতে হবে। বাজারভিত্তিক সুদহার করা হবে। তখন কেউ খেলাপি হবে না।”

পুঁজিবাজারের প্রসঙ্গে তিনি আগের মতোই বলেন, “যারাই না বুঝে বাজারে আসছেন, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। পুঁজিবাজারে আসলে লম্বা সময়ের জন্য আসেন।”

রাজস্ব আহরণ বাড়াতে কর হার না বাড়িয়ে আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা জানান এই প্রথম জাতীয় বাজেট দিতে যাওয়া মুস্তফা কামাল।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল (ফাইল ছবি)

এবারের বাজেট দেশের সাধারণ মানুষের বুঝতে পারার মতো করে উপস্থাপনের পরিকল্পনা জানান তিনি। বাজেটে প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।

অর্থমন্ত্রী বলেন, “দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী দক্ষ জনবল তৈরি করতে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। যেখানে রোবটিক্স, ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, এনার্জি স্টোরেজ বিষয়ে পড়ানো হবে।”

দেশের আগামী ৫০ থেকে শত বছরের চাহিদার কথা মাথায় রেখে শিক্ষা ব্যবস্থা সাজানোর উপরও জোর দেন তিনি।

ঢাকা শহরের যানজট কমাতে ইংল্যান্ডের আদলে শহরের চতুর্দিকে সার্কুলার ট্রেন চালুর পরিকল্পনা জানান অর্থমন্ত্রী।

এনজিও, গণমাধ্যম সম্পাদক এবং ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর এই আলোচনায় অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ ঢাকার যানজট কমানোর সুপারিশ করেন।

তিনি বলেন, “গাড়ি আমাদনির ট্যাক্স আরও বাড়িয়ে দিলে হয়ত ঢাকায় গাড়ি কমতে পারে।”

নগরীর খেলার মাঠগুলো দখলমুক্ত করার আহ্বানও জানান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কর্ণধার।

অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদারের সঞ্চালনায় এই আলোচনায় ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ও অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধূরী, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, গণস্বাক্ষরতা অভিযানের রাশেদা কে চৌধুরী, সুজনের বদিউল আলম মজুমদার, মহিলা পরিষদের মালেকা বানু,, ইউএসএআইডির ফারাহ কবীর প্রমুখ।

নঈম নিজাম রাজস্ব আহরন ব্যবস্থা আরও কার্যকরের পরামর্শ দিয়ে বলেন, “অনেক সময় দেখা যায়, একজন উদ্যোক্তার আয়কর একজন সাংবাদিকের চেয়ে কম। এটা কীভাবে সম্ভব।”

মতিউর রহমান বরাবরের মতোই সংবাদপত্রের জন্য নিউজ প্রিন্টের আমদানি শুল্ক কমানোর সুপারিশ করেন।

তিনি বলেন, “সংবাদপত্র শিল্প বিশ্বজুড়েই গভীর সঙ্কটে আছে। নিউজ প্রিন্ট আমদানিতে ৫ শতাংশ শুল্ক, ১৫ শতাংশ মূসক, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) ও অন্য খরচ মিলিয়ে মোট ৩১ শতাংশ।

“এ ছাড়া উৎসে কর দিতে হয় ৯ শতাংশ, যেখানে অনেক সংবাদপত্রের ৯ শতাংশ মুনাফাই হয় না। আবার পোশাক শিল্পের করপোরেট কর ১০ থেকে ১২ শতাংশ হলেও সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে তা ৩৫ শতাংশ।”

ইকবাল সোবহান চৌধুরী দেশের আর্থিক খাত ঠিক করতে হলে ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের উপর আস্থা ফিরিয়ে আনার তাগিদ দেন।

রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “যেসব মাওলানা হেলিকপ্টারে করে ওয়াজ করতে যান, তাদেরকে করের আওতায় আনতে হবে।”

তিনি শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ৫০০ টাকা করার প্রস্তাব দেন।

বদিউল আলম মজুমদার স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি আর্থিক খাতে সুশাসন ও দুর্নীতি বন্ধের আহ্বান জানান।

ফারাহ কবীর বলেন, “দেশে বিশাল অংশের নারী ১৮ বছরের মধ্যে মা হয়েছেন। এরপর তারা শিক্ষার সাথে নেই। তাদেরকে আবার শিক্ষায় ফেরাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”