জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ৩১ হাজার কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে।
অথচ এবারের বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য ঠিক করেছিল।
এ হিসাবে অর্থবছরের সাত মাসেই সঞ্চয়পত্র থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বেশি অর্থ ধার করে ফেলেছে সরকার।
পুঁজিবাজারের অস্থিরতা আর ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কম থাকায় গত কয়েক বছর ধরেই সঞ্চয়পত্র সাধারণের কাছে ‘বিনিয়োগের নিরাপদ ক্ষেত্র’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কিছুটা বাড়ানোর পরও সঞ্চয়পত্র বিক্রি খুব একটা কমেনি।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়।
বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কিছুটা বাড়িয়েছে…। কিন্তু মানুষ ব্যাংকের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। নিরাপদ বিনিয়োগ ভেবে সঞ্চয়পত্রই কিনছে।
পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিনের মন্দার কারণেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েছে বলে মনে করেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত।
বিক্রির চাপ বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিস থেকে সঞ্চয়পত্র কিনলে এখন তিন মাস পর ‘বই’ বা এ সংক্রান্ত ‘কাগজ (প্রমাণপত্র)’ দিচ্ছেন কর্মকর্তারা।
আগে সকালে কিনলে বিকেলেই অথবা দু-একদিন পরেই বই বা প্রমাণপত্র দেওয়া হত।
রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কার্যালয়ের নিচ তলায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়।
রোববার দুপুরে সেখানে গিয়ে বেশ ভিড় দেখা যায় এবং তার বেশিরভাগেই নারী। কেউ সঞ্চয়পত্রের বই জমা দিয়ে টোকেন নিয়ে মুনাফার জন্য অপেক্ষা করছেন। কেউ নতুন সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য ফরম পূরণ করে জমা দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
আরেক লাইনে পূরণ করা ফরম জমা দিয়ে টোকেন নিয়ে টাকা জমা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন অনেকেই।
এদেরই একজন মনিরা রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “টাকা জমা দিয়েছি…। রিসিট দিয়েছে। তিন মাস পরে এসে বই নিয়ে যেতে বলেছে।”
তবে যে তারিখে টাকা জমা দেওয়া হবে সেই তারিখের হিসাবেই মুনাফা দেওয়া হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
আগে সঞ্চয়পত্র কিনলে শুধু বই দেওয়া হত। এখন ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছে। যাদের যে কোনো ব্যাংকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে ফরম পূরণ করার সময় সেই ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত তথ্য দিলে প্রতি মাসে সেই অ্যাকাউন্টে মুনাফার অর্থ চলে যাবে। গ্রাহক ইচ্ছেমতো যখন-তখন মুনাফার অর্থ তুলতে পারবেন।
আবার মেয়াদ পূর্ণ হলে আসল টাকাও সেই অ্যাকাউন্টে চলে যায়। মুনাফা বা আসলের জন্য ব্যাংকে যেতে হবে না।
ইএফটি সঞ্চয়পত্র কেনেন তাদের কোন ‘বই’ দেওয়া হয় না। প্রমাণপত্র হিসেবে শুধু একটি কাগজ দেওয়া হয়।
বিক্রির লাগাম টেনে ধরতে এর আগে ২০১৫ সালের ১০ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ হার গড়ে ২ শতাংশ কমানো হয়েছিল। কিন্তু বিক্রি কমেনি।
এর পরেও দুই দফা সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কমানো হয়নি।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ‘ পেনশনার সঞ্চয়পত্র’ এবং মহিলাদের জন্য ‘পরিবার সঞ্চয়পত্র’ ছাড়া অন্য সঞ্চয়পত্রের সুদের হার দ্রুত কমানোর পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ৩০ হাজার ৯৯৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের একই সময়ে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার ৯৬৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
এ হিসাবে সাত মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি বেড়েছে ৭ শতাংশ।
এক মাসের বিক্রিতে রেকর্ড
সর্বশেষ জানুয়ারি মাসে ৬ হাজার ৩ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর আগে কখনই এক মাসে এতো টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়নি।
অর্থ্যাৎ প্রয়োজন হোক বা না হোক জানুয়ারি মাসে সরকারকে ১১/১২ শতাংশ হারে ৬ হাজার কোটি টাকার সুদ দিতে হয়েছে।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ১৩৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এ হিসাবে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি বেড়েছে ১৮ শতাংশের মতো।