সৌদি প্রতিনিধিদের সফর ভাবী বিনিয়োগের প্রথম ধাপ: গোলাম মসীহ

সৌদি আরবের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সাম্প্রতিক সফর দারুণ আশার সঞ্চার করেছে বাংলাদেশ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে। বলা হচ্ছে, এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের সৌদি বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

অরুণ দেবনাথ ও সৌমিক হাসিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 March 2019, 01:49 PM
Updated : 10 March 2019, 05:46 PM

বাংলাদেশে এর আগে আর কখনও সৌদি আরব থেকে এত বড় কলেবরের প্রতিনিধি দল আসেনি। এই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন সৌদি আরবের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ মন্ত্রী মাজেদ বিন আব্দুল্লাহ আল-কাসাবি এবং অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী মোহাম্মদ বিন মেজইয়ে আলতাইজরি।

প্রায় প্রতিটি ব্যবসায়িক সমঝোতার পেছনে একজন ব্যক্তির ভূমিকা থাকে, যিনি সামনে না এলেও দুই পক্ষের মতৈক্যের ক্ষেত্রটি তৈরি করে দিতে কাজ করেন। এক্ষেত্রে সেই লোকটি হলেন সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ।

জাতীয় পার্টির সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম মসীহকে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে রাষ্ট্রদূত করে সৌদি আরবে পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ দায়িত্বের বিষয়ে গোলাম মসীহ সব সময়ই সচেতন।  

তিনি বলছেন, সৌদি প্রতিনিধি দলের ওই সফর বর্তমানের জন্য যতটা গুরুত্ব বহন করে, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যতের জন্য। যে দুটি চুক্তি আর চারটি সমঝোতা স্মারক দুই দেশের মধ্যে হয়েছে, তার চেয়ে এ সফর অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।  

শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সৌদি-বাংলাদেশ সম্পর্ক, সেখানে বাংলাদেশের শ্যমিকদের পরিস্থিতি এবং গত চার বছরে সৌদি আরবের পরিবর্তনগুলো নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন এই রাষ্ট্রদূত।  

এমনকি গতবছর ইস্তাম্বুলে সৌদি কনসুলেটে ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট জামকাল খাশুগজি হত্যাকাণ্ডের মত অপ্রীতিকর বিষয়েও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন গোলাম মসীহ। 

নারী স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য প্রশংসিত সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ওই হত্যাকাণ্ডের পর থেকে পশ্চিমা মিত্রদের সমালোচনার মুখে রয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়ায় সম্পর্কোন্নয়নে মনোযোগী হয়েছে সৌদি আরব।

এর অংশ হিসেবে গত ফেব্রুয়ারিতে এশিয়ার কয়েকটি দেশ সফর করেছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ, ভারত ও পাকিস্তনে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি এসেছে তার সেই সফরে।    

বাংলাদেশের কর্মকর্তারা সৌদি প্রতিনিধি দলের সফরকে যুবরাজ মোহাম্মদের সফরের প্রাক প্রস্তুতি হিসেবেই দেখছেন। রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহর ধারণা, যুবরাজের সম্ভাব্য সেই সফর খুব বেশি দূরে নয়।

গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সৌদি প্রতিনিধি দল যে চুক্তি ও সমঝোতাগুলোতে সই করেছে, তার মধ্যে  ফেনীতে ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সৌদি আলফানার কোম্পানির সঙ্গে ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশের ১০ কোটি ডলারের একটি চুক্তি এবং ট্রান্সফর্মার ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম উৎপাদনে সৌদি কোম্পানি ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশনের সঙ্গে বাংলাদেশের জেনারেল ইলেকট্রিক ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি লিমিটেডের ৩৫ কোটি ডলারের একটি চুক্তি রয়েছে। 

গোলাম মসীহ বলেন, “ওই চুক্তি ও সমঝোতাগুলো এ সফর থেকে আমাদের মূল অর্জন নয়। মূল বিষয়টা হল দুই দেশের সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস আরও মজবুত হয়েছে, যেটা নিয়ে প্রতিনিধি দল আরও কাজ করবে।

“সৌদি আরবে ফিরে তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভবনাময় ক্ষেত্রেগুলোর কথা তাদের কর্তৃপক্ষকে জানাবেন। তাতে সেদেশের বিনিয়োগকারীরা জানতে পারবেন যে তাদের বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশই আদর্শ জায়গা এবং এখনই তার সঠিক সময়।”

“তাদের সফরে ছয়টা চুক্তি-সমঝোতা হয়েছে।  ওই প্রতিনিধি দলে ৩২ জন ছিলেন, যারা আরামকোসহ সৌদি আরবের অন্তত ২০টি বড় কোম্পানির প্রতিনিধি। কিন্তু এই সফরের তাৎপর্য এসব সংখ্যা দিয়ে মাপা যাবে না।“

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়নের গল্পটা সৌদি প্রতিনিধি দলের সদস্যদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়বে এবং আরও অনেককে তা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী করে তুলবে বলে গোলাম মহীস আশা করছেন।

জ্বালানি তেল রপ্তানিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোম্পানি আরামকো তেল শোধন ও পেট্রোকেমিকেলের বাজারেও শীর্ষস্থানে পৌঁছানোর চেষ্টায় পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। সৌদি সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তেল শিল্পের বিভিন্ন খাত থেকে লাভ বাড়াতে চাইছে তারা।     

বাংলাদেশে একটি শোধনাগার ও সংরক্ষণাগার নির্মাণের সম্ভাব্যতা নিয়ে ইতোমধ্যে তারা প্রাথমিক আলোচনা করেছে। কেবল বাংলাদেশ নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার বাজার ধরাই তাদের এ পরিকল্পানার উদ্দেশ্য।

গোলাম মসীহ বলেন, সব ঠিক থাকলে কেবল এ প্রকল্পেই ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলারের সৌদি বিনিয়োগ পেতে পারে বাংলাদেশ। 

বাংলাদেশ যদি আরামকোর ওই বিনিয়োগ পায়, তা হবে আগামী ১০ বছরে বিশ্বজুড়ে এই সৌদি কোম্পানির ৫০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার অংশ। এর মধ্যে ১৬০ বিলিয়ন ডলার প্রকৃতিক গ্যাস শিল্পের উন্নয়নে এবং ১০০ বিলিয়ন ডলার পেট্রোকেমিকেল খাতে বিনিয়োগ করতে চায় তারা।

বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগের অংক নিয়ে যে অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে, তাও দূর করার চেষ্টা করেছেন রাষ্ট্রদূত মসীহ।

তিনি বলেন, সৌদি কোম্পানিগুলো কোন কোন খাতে বিনিয়োগ করতে পারে, তার একটি সম্ভাব্য তালিকা প্রতিনিধি দলকে দিয়েছে বাংলাদেশ। সেসব প্রকল্পের মোট আকার ৩৫ বিলিয়ন ডলার।  

এখন দুই দেশের একটি যৌথ কমিটি এসব প্রকল্প প্রস্তাব পর্যালোচনা করবে। আসন্ন রমজান মাসের শুরুর দিকে জেদ্দায় ওই কমিটির প্রথম বৈঠক হবে। ওই বৈঠকেই এসব প্রকল্পের সম্ভাব্যতা বিচার করে দেখবেন তারা। 

গোলাম মসীহ বলেন, “বাংলাদেশ যে ৩৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রত্যাশা করছে, তার পুরোটাই পাওয়া সম্ভব হবে বলে আমি আশাবাদী। তারা খুবই আগ্রহী, ফলে আমি মোটামুটি নিশ্চিত, বাংলাদেশে এযাবতকালের সবচেয়ে বড় সৌদি বিনিয়োগ হতে যাচ্ছে এটা।” 

সফরের আগে

বাংলাদেশে সৌদি প্রতিনিধি দলের সফর দৈর্ঘ্যে সংক্ষিপ্ত হলেও এর আয়োজন করতে প্রায় এক বছর সময় লেগেছে বলে জানান রাষ্ট্রদূত মসীহ।  

তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অব্যাহত চেষ্টার ফলেই সৌদি বিনিয়োগের সম্ভাব্যতা এই পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে।

তবে গোলাম মসীহ এক্ষেত্রে শেখ হাসিনার ভূমিকার কথা সবার আগে বলতে চান, যিনি তাকে রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ দেওয়ার আগে থেকেই সৌদি বিনিয়োগের গুরুত্বের কথা বলে আসছিলেন।  

রাষ্ট্রদূত বলেন, গত অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফরে তার উন্নয়ন দর্শন এবং তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয় সৌদি রাজপরিবার।

“সেই বৈঠকেই সৌদি যুবরাজ প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, তাদের হাতে উদ্বৃত্ত থাকা অর্থ বাংলাদেশের কোন কোন খাতে বিনিয়োগ করা যায় তা দেখতে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলকে ঢাকায় পাঠাচ্ছেন তিনি।”  

সৌদি যুবরাজের বাংলাদেশ সফরের কোনো সম্ভাবনা আছে কি না জানতে চাইলে গোলাম মসীহ বলেন, প্রিন্সের পরিকল্পনাতেও এটা আছে।

“যে প্রতিনিধি দলটা বাংলাদেশ ঘুরে গেল, তাকে আপনি অগ্রবর্তী দল বলতে পারেন। যে দুজন মন্ত্রী এসেছিলেন, তারা দুজনই সৌদি কেবিনেটের সিনিয়র সদস্য।” 

সৌদি বিতর্কগুলো

সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশুগজি হত্যাকাণ্ড এবং ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের যুদ্ধ নিয়ে প্রশ্নে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ।

তার যুক্তি, এ বিষয়গুলো সরাসরি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। 

“আমাদের পররাষ্ট্রনীতি খুব স্পষ্ট। সৌদি আরব হল বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার। সেই সঙ্গে একক দেশ হিসেবে সৌদি আরব থেকেই সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আমরা পাই। কাজেই ওইসব জটিলাতায় জড়ানোর কোনো আগ্রহ আমাদের নেই। মাথা ঘামানোর মত আরও অনেক জরুরি বিষয় আমাদের সামনে আছে।”   

গোলাম মসীহ বলেন, ১৯৭৫ সাল থেকে সৌদি আরব ও বাংলাদেশের মধ্যে অত্যন্ত আন্তরিক সম্পর্ক বিদ্যমান এবং এই সম্পর্কের স্বীকৃতি হিসেবে দুই দেশই আন্তর্জাতিক ফোরামে পরস্পরকে সমর্থন দিয়ে এসেছে।

সৌদি আরব যেখানে ইয়েমেনে যুদ্ধ করছে, সেখানে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রাষ্ট্রদূত বলেন, এ বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে অনেক ‘ভুল ধারণা’ রয়েছে।

ওই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশি সৈন্যরা সৌদি আরবে সরাসরি কোনো যুদ্ধে অংশ নেবেন না বলে ধারণা দেন গোলাম মসীহ।

“আমাদের লোকজন সেখানে হয়ত প্রকৌশল দেখবে, লজিস্টিকস দেখবে, সীমান্তে নজর রাখবে। কিন্তু সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার মত কোনো বিষয় এখানে নেই, কেননা সেটা হবে জাতিসংঘের একটি শান্তিরক্ষী দেশ হিসেবে আমাদের প্রতিশ্রুতির লঙ্ঘন।”

কর্মী নিপীড়ন

সৌদি বিতর্কের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেও সেখান থেকে বাংলাদেশের নারী কর্মীদের ফিরে আসার বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ।

এই নারীরা সৌদি আরবে গিয়েছিলেন গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে। ফিরে আসার পর তাদের অধিকাংশই বিভিন্নভাবে নিপীড়িত হওয়ার অভিযোগ করেছেন।

গোলাম মসীহ বলেন, সংবাদমাধ্যম যে ঘটনাগুলো সামনে এনেছে, তার বাইরেও বেশ কিছু জটিলতা এক্ষেত্রে রয়েছে।

“দুর্ভাগ্যজনক কিছু ঘটনা সেখানে ঘটেছে। আমাদের প্রায় আড়াই লাখ নারী কর্মী সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের মধ্যে দেশে ফিরে এসেছেন ১১ হাজারের মত, যা মোট সংখ্যার ৫ শতাংশের কম।    

“যারা ফিরে এসেছেন, তাদের একটি অংশ নিপীড়নের শিকার হওয়ার কথা বলেছেন। আরও অনেকে আছেন যাদের মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছিল। ফলে এর দায়টা পড়ে এজেন্ট আর সরকারি সংস্থাগুলোর ওপর, যারা লোক পাঠানোর কাজটা দেখে।”

রাষ্ট্রদূত জানান, কোনো এজেন্টের মাধ্যমে নারী গৃহকর্মী নেওয়ার সময় একটি সৌদি পরিবার ২০০০ ডলার দেয়। সেই কর্মী যাতে তার কাজ ঠিকভাবে করতে পারেন, সেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব সেই এজেন্টের।

কিন্তু বাংলাদেশের গ্রাম থেকে সৌদি আরবে যাওয়া নারীদের অনেকেই ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন সংস্কৃতিতে মানিয়ে নিতে বড় ধরনের সমস্যায় পড়েন বলে জানান মসীহ।

তিনি বলেন, ফিলিপিন্স সরকার সাড়ে সাত লাখ নারীকে গৃহকর্মীর কাজে সৌদি আরবে পাঠিয়েছে। যাওয়ার পর সেখানে তাদের বাধ্যমাতমূলকভাবে তিন মাসের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। 

“প্রশিক্ষণ শেষে তাদের তিন মাসের জন্য দেশে পাঠানো হয়, যাতে তারা দীর্ঘ মেয়াদে সন্তান বা বাবা-মাকে ছেড়ে থাকার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশে একজন নারীকে গ্রাম থেকে নিয়ে আসার ১৫ দিনের মধ্যে সৌদি আরবে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”

বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোকে (বিএমইটি) এই গৃহকর্মীদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানান গোলাম মসীহ।

যে নারীরা কাজ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন, তাদের জন্য বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে কী করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের আশ্রয়, নিরাপত্তা এবং আইনি সহয়তা দিতে সরকার সব সময়ই প্রস্তুত। 

“কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, তারা আদালতে যেতে চান না। সেজন্য তারা সেখানে থাকতেও চান না। ওই রকম অবস্থায় পড়লে তারা কেবল দেশে ফিরে আসার কথা ভাবেন।”

রাষ্ট্রদূত জানান, তার সময়ে দূতাবাসের পক্ষ থেকে সৌদি আরবে একটি সেইফ হাউজ খোলা হয়েছে, যেখানে ৫০০ মানুষের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশি কর্মীদের কারও নিপীড়িত হওয়ার অভিযোগ পেলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তা স্থানীয় পুলিশকে জানানো হচ্ছে। সৌদি কর্তৃপক্ষও এ ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে দ্রতই সাড়া দিচ্ছে। 

বদলে যাওয়া কূটনীতি

রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ বলেন, প্রবাসে থাকা বাংলাদেশি কর্মীরা যাতে সরকারের সেবাগুলো আরও সহজে পেতে পারে, তা নিশ্চিত করা ছিল তার প্রথম অগ্রাধিকার।

তিনি বলেন, চার বছর আগে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়ে সৌদি আরবে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে বলেছিলেন, তিনি যেন প্রবাসীদের কল্যাণে কাজ করেন। তাদের কনসুলার সেবা পাওয়াটা যেন সহজ হয়। তারা যেন এটা মনে করতে পারে যে, এটা তাদেরই দূতাবাস, প্রয়োজনে তারা দূতাবাসকে পাশে পাবে।    

“অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমাকে বলতে হচ্ছে, এটা নিশ্চিত করতে গিয়ে দূতাবাসের অনেক কর্মীকে আমার বরখাস্ত করতে হয়েছে, কেননা তারা সেবা নিতে আসা মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিল।”

দূতাবাসের এক ডজনের বেশি কর্মীকে এ কারণে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে তথ্য দেন রাষ্ট্রদূত। 

“আমি তাদের বলি (দূতাবাসের কর্মীদের), যারা আমাদের কাছে সেবা নিতে আসে, তাদের ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে কাজ করতে হয়। তারা যদি চিৎকারও করে, আমরা তাদের সঙ্গে উল্টো চিৎকার করতে পারি না।

“আমরা দূতাবাসে এসি ঘরে বসে থাকি, সরকারের কাছ থেকে বেতন পাই। সুতরাং যে সেবাটার জন্য মানুষ আমাদের কাছে আসে, সেটা তাদের দিতে হবে।

“তারা এখানে আসে যাতে তাদের কষ্টের আয়ের টাকা ঠিকমত দেশে পাঠানো যায়। তাদের হাত দিয়েই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। কাজেই সেই সম্মান আর মর্যাদাটুকু তাদের প্রাপ্য।” 

গোলাম মসীহ বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফরেইন সার্ভিস অনেকটা বদলে গেছে, আর মানুষের চাহিদা মেটানোর জন্যই এ পরিবর্তনটা আসছে।

“আমি অন্য দূতাবাসগুলোর কর্মকাণ্ড খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করি। সময়টা এখন আসলেই বদলে গেছে। অধিকাংশ দেশ এখন অর্থনৈতিক কূটনীতির দিকেই বেশি নজর দিচ্ছে। আমার মনে হয়, রাজনৈতিক কূটনীতির প্রয়োজন এখন অনেকখানি ফুরিয়েছে।”

এই রাষ্ট্রদূত বলেন, কূটনীতিতে এখন সফল হওয়ার জন্য বাংলাদেশে পররাষ্ট্র সেবায় আরও দক্ষ কর্মী প্রয়োজন, গবেষণা ও অর্থনৈতিক সেলকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন, সেই সঙ্গে প্রয়োজন ঊর্ধ্বতনদের কাছ থেকে স্পষ্ট দিক নির্দেশনা। 

মসীহর ভাষায়, তার মত যারা ‘নন ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট’, অর্থাৎ ভিন্ন কোনো পেশা থেকে যারা কূটনেতিক দায়িত্বে এসেছেন, তাদের প্রায় সবাই খুব উদ্যোগী, যদিও কখনও কখনও তারা প্রটোকলের বিষয়টা ভুলে যান।

“আমার মনে হয় এই সময়ে প্রটোকল আর অত বড় কোনো বিষয় নেই। বিশ্ব এখন অনেক বেশি উন্মুক্ত। সবাই চায় তথ্যের প্রবাহ যেন অবাধ হয়, আলোচনাটা যেন হয়। কূটনীতির মাত্রাগুলো এখন বদলে গেছে।”   

তবে দীর্ঘদিন ধরে কূটনীতি পেশায় থাকা সহকর্মীদের কাছ থেকে যে দারুণ সহযোগিতা পেয়েছেন, সে কথাও রাষ্ট্রদূত বলেন। 

কূটনৈতিক দায়িত্বে তার স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ারে সৌদি বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরির বিষয়টি হয়ত একটি বড় সাফল্য হয়ে থাকবে। আর এক্ষেত্রে নতুন লব্ধ কূটনৈতিক দক্ষতার সঙ্গে রাজনীতি আর ব্যবসার অভিজ্ঞতাও সহায়ক হয়েছে বলে তার বিশ্বাস।

গোলাম মসীহর ভাষায়, “শেষ পর্যন্ত সবগুলো বিষয়ের একটা ভারসাম্য আসলে প্রয়োজন হয়।”