আট মাসে ১৩% বেশি রপ্তানি আয়

রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক ধারা ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।টানা ছয় মাস ধরে বাড়ছে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচক।

আবদুর রহিম হারমাছিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2019, 01:26 PM
Updated : 7 March 2019, 05:03 PM

চলতি অর্থবছরের আট (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ দুই হাজার ৭৫৬ কোটি (২৭.৫৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে।

এই অংক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি। আর গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে আয় বেশি এসেছে ১৩ শতাংশ।

সর্বশেষ জানুয়ারি মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ১০ দশমিক ১২  শতাংশ বেশি অর্থ দেশে এসেছে।

জাতীয় নির্বাচনের পর স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে রপ্তানি আয় বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতির বিশ্লেষক, ব্যাংকার এবং রপ্তানিকারকরা। আগামী মাসগুলোতে রপ্তানি আয় আরও বাড়বে বলে আশা করছেন তারা।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোর মতো রপ্তানির অবস্থাও ভালো।

গত অর্থবছরে খুব একটা প্রবৃদ্ধি না হলেও চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই বেশ গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। । ১৩/১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি খুই ভালো। নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার সরকারই দায়িত্ব নিয়েছে। কোন অস্থিরতা নেই। সরকারের ধারাবাহিকতায় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা থাকে। রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে।

“আমার বিশ্বাস স্বস্তির পরিবেশে বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি পোশাক কিনবে বায়াররা। আগামী দিনগুলোতে রপ্তানি আয় আরও বাড়বে।”

৩০ জানুয়ারি চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, মুদ্রানীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে সমর্থন যোগানো। সেই লক্ষ্য অর্জনে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক ধারা চলতি অর্থবছরেও অব্যাহত রয়েছে।

“ডিসেম্বর নাগাদ দেশজ ও বৈদেশিক চাহিদার সূত্রে উৎপাদন কর্মকান্ডের জন্য উপকরণাদি আমদানি ১৭.৯২% এবং রপ্তানির ১৪.৪% প্রবৃদ্ধি তারই সাক্ষ্য।”

“উৎপাদন কর্মকান্ডে কোন বিঘ্ন ব্যতিরেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর অর্থবর্ষের দ্বিতীয়ার্ধে বিনিয়োগ ও উৎপাদন কর্মকান্ডের ধারা আরও জোরালো হবে প্রত্যাশা করা যায়।”

তৈরি পোশাক রপ্তানির উপর ভর করেই রপ্তানি আয় বাড়ছে জানিয়ে বিজিএমইএর সহসভাপতি ফারুক হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের পোশাকের প্রতি ক্রেতাদের আস্থা বেড়েছে। আমরা এখন বেশি দামের পোশাকও রপ্তানি করছি। নতুন নতুন বাজারে প্রবেশ করছি আমরা।জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ।”

“সার্বিকভাবে সব কিছুই এখন আমাদের অনুকূলে।সে কারণেই বাড়ছে রপ্তানি আয়।”

অর্থবছরের বাকি মাসগুলোতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশার কথা শোনান ফারুক হাসান।

বৃহস্পতিবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি থেকে ২ হাজার ৭৫৬ কোটি ২৮ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ।

এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ৯৮ শতাংশ বেশি।এই ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ।

জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৫৫৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

গত বছরের এই আট মাসে আয় হয়েছিল দুই হাজার ৪৩৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৮ কোটি ৩২ লাখ ডলার রপ্তানি আয় দেশে এসেছে।এই মাসে লক্ষ্য ধরা ছিল ৩১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আয় হয়েছিল ৩০৭ কোটি ২১ লাখ ডলার।

এ হিসাবে ফেব্রুয়ারি মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ।আর পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) আয় বেড়েছে ১০ দশমিক ১২ শতাংশ।

ইপিবির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, জুলাই- ফেব্রুয়ারি সময়ে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ৫১ শতাংশ।

অর্থাৎ ২৭ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ২৩ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারই এসেছে এ খাত থেকে।

এর মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে এক হাজার ১৪৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ।

উভেন পোশাক রপ্তানি করে আয় হয়েছে এক হাজার ১৬৩কোটি ৩৩ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ

নিটে লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেড়েছে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর উভেনে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ।

অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০ শতাংশের মতো। কিন্তু দ্বিতীয় মাস অগাস্টেই তা হোঁচট খায়। ওই মাসে গত বছরের অগাস্টের চেয়ে আয় কমে ১২ শতাংশ।এর পরের মাস থেকে তৈরি পোশাকসহ সামগ্রিক রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।

ডিসেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৪ দশমিক ৪২ শতাংশ।জানুয়ারিতে ৮ শতাংশ।

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ওপর বরাবরই তৈরি পোশাক পণ্যের বড় ধরনের প্রভাব থাকে।পোশাক শিল্প মালিকরা গত কয়েক বছরে তাদের কারখানার উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নেওয়ায় ক্রেতাদের আস্থা বৃদ্ধি রপ্তানি আয় বাড়াতে অবদান রেখেছে বলে মনে করেন পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি ফারুক হাসান।

“অর্থবছরের শুরুটা খুব ভালো হয়েছিল।কোরবানির ঈদের কারণে কয়েকদিন কারখানা এবং রপ্তানি কার‌্যক্রম বন্ধ থাকায় অগাস্ট মাসে কিছুটা ধাক্কা খেয়েছিল।সে ধাক্কা আমরা সামলে নিয়েছি।এখন প্রতি মাসেই রপ্তানি আয় বাড়ছে।”

অর্থবছরের বাকি মাসগুলোতে আয় বাড়বে আশা করে তিনি বলেন, “কারখানাগুলোর উন্নয়নে পোশাক শিল্প মালিকরা গত কয়েক বছরে অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছেন।কষ্টও করেছেন। ৮০ শতাংশের বেশি কারখানা উন্নত কর্মপরিবেশের (কমপ্লায়েন্স) আওতায় চলে এসেছে। এতে বায়াররাও খুশি।”

এ কারণেই বিদেশি ক্রেতাদের আস্থার সঙ্গে ক্রয়াদেশও বাড়ছে বলে মনে করেন বিজিএমইএ সহসভাপতি।

“খুশির খবর হচ্ছে আমরা এখন অনেক বেশি দামের পোশাকও রপ্তানি করছি।আমরা ক্রেতাদের পছন্দ এবং ডিজাইনের পণ্য দিতে পারছি। আমাদের প্রতি তাদের আস্থা বাড়ছে।”

তবে ভারত, চীন, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ মার্কিন ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রার ব্যাপক দরপতন করায় বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে বলে মনে করেন তিনি।

“যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে তাতে আমেরিকার বাজারে চীনের পোশাক রপ্তানি কমে যাবে।সেই বাজার বাংলাদেশের দখল করার সম্ভাবনা আছে। সেটা হলে আমাদের রপ্তানি আরও বাড়বে।”

অন্যান্য পণ্য

অন্যান্য পণ্যের মধ্যে জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে কৃষিপণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৬৪ কোটি ২৭ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৮ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি।

তবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতে রপ্তানি আয় ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ কমেছে। এ খাতে আয় দাঁড়িয়েছে ৬৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার।

একইভাবে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি আয়ও কমেছে। এ খাতে আয় হয়েছে ৭১ কোটি ১২ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ কম।

গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ তিন হাজার ৬৬৬ কোটি ৮২ লাখ (৩৬.৬৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করে। এরমধ্যে ৩০ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারই এসেছিল তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে।

অর্থাৎ মোট রপ্তানির ৮৩ দশমিক ৫০ শতাংশই এসেছিল এই খাত থেকে।

গত অর্থবছরের সার্বিক রপ্তানি ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ বাড়লেও তা ছিল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ২২ শতাংশ কম।

চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি করে ৩৯ বিলিয়ন (তিন হাজার ৯০০ কোটি) ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি।

এবার দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাত থেকে ৩২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার আসবে বলে ধরা হয়েছে, যা মোট রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার ৮৩ দশমিক ৮২ শতাংশ।