বিনিয়োগে স্থবিরতা কাটছে না

অর্থবছরের প্রথমার্ধে কলকারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানির প্রবণতা কমেছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহও আগের তুলনায় কমে এসেছে, ফলে বিনিয়োগে স্থবিরতা কাটছে না।

আবদুর রহিম হারমাছিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Feb 2019, 04:56 AM
Updated : 8 Feb 2019, 05:59 AM

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ২৩৮ কোটি ৬০ লাখ ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।

২০১৭-১৮ অর্থবছরের একই সময়ে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৩২৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। এ হিসাবে ছয় মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ২৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে শিল্প খাতের বিকাশের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলার পরিমাণ ৩৫ শতাংশ বেড়েছিল।

উন্নয়নের ডামাডোলের মধ্যেও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন।

তিনি বলছেন, অনেক দিকে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ এখনও ‘অনুপস্থিত’।

“ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি কমা মানে দেশে বিনিয়োগ কম হচ্ছে। ব্যাংকগুলো বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে না। সুদের হার বেশি। এখনও ১৩/১৪ শতাংশ। এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও কোন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।”

অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু ডিসেম্বর শেষে দেখা যায়, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ, যা লক্ষ্যের চেয়ে অনেক কম।

গত ৩০ জানুয়ারি জানুয়ারি-জুন সময়ের মুদ্রানীতির ঘোষণায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমার সম্ভাব্য একটি ব্যাখ্যা দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির।

তিনি বলেন, গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে ব্যবসায়ীদের ‘অনিশ্চয়তার শঙ্কা’ এর একটি কারণ হয়ে থাকতে পারে।

তবে এফবিসিসিআই সভাপতি বলছেন, জাতীয় নির্বাচন মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বা বিনিয়োগ কমার ‘মূল কারণ নয়’।

“বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে। এবার ভোটের আগেও কোনো অস্থিরতা ছিল না। অনেকটা নিশ্চিত ছিল যে আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় আসবে।

“আমি মনে করি, বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারাই এ স্থবিরতার কারণ। যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে বিনিয়োগ।”

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ এর ঘরে, সেই প্রবৃদ্ধি এই দশ বছরে বেড়ে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ হয়েছে।

কিন্তু ২০১৮ সালের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে, গত সাত বছরে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির আনুপাতিক হারে বেড়েছে সামান্যই।  

অর্থবছর

জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের পরিমাণ

২০১৭-১৮

৩১ দশমিক ৪৭ শতাংশ

২০১৬-১৭

৩০ দশমিক ৫১ শতাংশ

২০১৫-১৬

২৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ

২০১৪-১৫

২৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ

২০১৩-১৪

২৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ

২০১২-১৩

২৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ

২০১১-১২

২৮ দশমিক ২৬ শতাংশ

সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের পরও বিনিয়োগ না বাড়ার কারণ হিসেবে সুদের হার ছাড়াও আরও অনেক সমস্যার কথা বলছেন এফবিসিসিআই সভাপতি।  

“জমি সমস্যা আছে, প্রচুর দাম। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হলেও গ্যাস সংকট রয়েই গেছে। আছে বন্দর সমস্যা।”

নতুন মেয়াদে সরকারকে এসব বিষয়ে আরও মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, “সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যাংকের পাশাপাশি শেয়ারবাজার থেকেও যাতে উদ্যোক্তারা অর্থ পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে।”

দেশি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সরকার সারা দেশে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে কাজ করছে। কিন্তু সেগুলো চালু হতে সময় লাগবে। তার আগে বিনিয়োগ বাড়াতে ‘দৃশ্যমান উদ্যোগ’ চান ব্যবসায়ী নেতা সফিউল ইসলাম।

তিনি বলেন, “একটা বিষয় সবাইকে মনে রাখতে হবে, বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না। আর কর্মসংস্থান বাড়ানোই এখন আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।”

মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কেন কমছে, তার অন্য একটি ব্যাখ্যা রয়েছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখতের কাছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গত অর্থবছর ক্যাপিটাল মেশিনারিজের আমদানি যেটা বেড়েছিল তা মূলত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা সেতুসহ বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পের কাজের জন্য। ওই আমদানির যন্ত্রপাতি উৎপাদনশীল কাজে খুব একটা ব্যবহার হয়নি।”

চলতি অর্থবছরে এ সব বড় প্রকল্পের জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারি আনার খুব একটা প্রয়োজন না হওয়ায় আমদানি কমেছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

এফবিসিসিআই সভাপতির সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করে জায়েদ বখত বলেন, “জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের মধ্যে এক ধরনের ভয় ছিল। নির্বাচনের আগে-পরে কি হয়; আবার অস্থিরতা দেখা দেয় কিনা- সেই শঙ্কা ছিল। সে কারণে সবাই চিন্তাভাবনা করে দেখেশুনে আমদানি করেছে।”

তবে ভোট ঘিরে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি না হওয়ায় সেই শঙ্কাও কেটে গেছে বলে মনে করেন এই গবেষক।

রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত তিনি বলেন, “সরকারের ধারাবাহিকতায় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ও বিনিয়োগ বাড়ে। আমার বিশ্বাস এবার বিনিয়োগ বাড়বে,”