প্রয়োজনে ডাকবেন: মুস্তফা কামালকে মুহিত

রেকর্ড সংখ্যক জাতীয় বাজেট দিয়ে অবসর নিলেও আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে সহযোগিতার আগ্রহ দেখালেন সদ্য বিদায় নেওয়া অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Jan 2019, 02:36 PM
Updated : 24 Jan 2019, 02:42 PM

বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে মুহিত পাশে বসা মুস্তফা কামালের উদ্দেশে বলেন, “আগামী বছরের বাজেটের জন্য কিছু তৈরি করা আছে। যখন প্রয়োজন হয় তখনই আপনি ডাকতে পারেন, আমি উপস্থিত হয়ে যতদূর সম্ভব করব।

“আমি অবসরে যাচ্ছি, কিন্তু কাজ-কর্ম থেকে বিদায় নয়। আমার এখন সময় আছে। আগামী এপ্রিলের আগে আমার বিদেশে যাওয়ারও কোনো পরিকল্পনা নেই।”

এইচ এম এরশাদের সামরিক সরকারে দুটি বাজেট দেওয়া মুহিত ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকারে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর টানা ১০টি বাজেট দিয়ে এবার রাজনীতি থেকে ছুটি নিয়েছেন।

শেখ হাসিনার নতুন সরকারে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন গত পাঁচ বছর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলে আসা মুস্তফা কামাল।

মুহিতকে বিদায় এবং মুস্তফা কামালকে স্বাগত জানাতে বৃহস্পতিবার একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সেখানে দুজনই একসাথ হয়েছিলেন।

পূর্বসূরির প্রশংসা করে মুস্তফা কামাল বলেন, “গত ১০ বছরে আমাদের দেশের অর্থনীতি এ পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে মুহিত ভাইয়ের অবদান সবচেয়ে বেশি।

“তার কাজেই তার মেধার পরিচয় পাওয়া যাবে। বিভিন্নভাবে তিনি আমাদের মাঝে আছেন। তিনি ৫৪৩ ডলারের মাথাপিছু আয় থেকে এক হাজার ৭৫১ ডলারে উন্নীত করেছেন।”

ঢাকার সেগুনবাগিচায় জাতীয় রাজস্ব ভবনে এক অনুষ্ঠানে বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে স্বাগত জানানো হয়। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

মুহিতকে ‘জাতির বিবেক’ সম্বোধন করে তিনি বলেন, “তিনি মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেছেন, যা নিয়ে তিনি বিতর্কিত হয়েছেন। অথচ তিনি যা সত্য, তাই বলেছেন। এটাই হওয়া উচিৎ।”

মুহিত বলেন, “এই ১০ বছরে আমি যা কিছু অর্জন করেছি, তার পেছনে কিন্তু রয়েছেন একজন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস করে একজন বুড়ো মানুষকে কাজ করতে লাগিয়েছিলেন, আমি তখনও বলেছিলাম যে দেখেন আমার বয়স ৭৪ বছর হয়ে যাচ্ছে, এখন আপনি আমাকে এরকম ধরনের কাজ-কর্ম দেন, যেখানে এপ্লিকেশন একটু কম লাগবে। কিন্তু তিনি এসব শুনেন-টুনেন নাই।”

উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারের ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতা দুটোই থাকার প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন মুহিত।

“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুইটা টার্মে কন্টিনিউয়াস থাকলেন, তার ফলেই গত ১০ বছরে অসাধারণ সফলতা পেয়েছে। এবার তিনি আরও পাঁচ বছর পেলেন। আমার বিশ্বাস, টানা আরেকটি সুযোগে তিনি প্রবৃদ্ধির সড়ককে আরও উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবেন।”

পুরনো গল্প

পঁচাশি বছরে পা রাখতে যাওয়া মুহিত এই অনুষ্ঠানে এসে নিজের জীবনের নানা গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেন। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র থেকে কীভাবে অর্থনীতির জটিল জগতে এসে গেলেন, তা বলেন তিনি।

মুহিত বলেন, “আমি সিভিল সার্ভিসে যোগ দিই ১৯৫৬ সালে। এরপর পাকিস্তান আমলে রেলওয়ে মন্ত্রণালয় হল, সেখানে আমার চাকরি হল। সেই চাকরির সুবাদে বাজেটের সঙ্গে আমার পরিচয়।

“রেলওয়ে বাজেটটা আমাদের প্রথম বানাতে হল ১৯৬২ সনে। সেই জন্য কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার আমাদের কিছু ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করল। আমরা পিন্ডিতে গেলাম। কাজী আবদুর রহিম অর্থ মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি আর আমি, দুজন গেলাম পাকিস্তানে।

“সেই বছর আরেকটা নতুন জিনিস পাকিস্তানে সৃষ্টি হয়েছে যে এক্সপেনডিচারের মধ্যে নিউ এক্সপেনডিচার দুটি আইটেম করা হয়েছে। যতগুলো নিউ এক্সপেনন্ডিচার আসবে, সেটা সম্বন্ধে প্রজেকশন দিতে হবে যে ৩, ৪ বা ৫ কত বছর লাগবে? সেটার জন্য একটা বাজেটের ছক তৈরি করতে হবে।

“সেই কাজটায় সম্ভবত এম এম খান এবং গোলাম ইসহাক এই দুজন মূল্যবান অবদান রাখেন। এই আমার হাতে খড়ি হল ফাইন্যান্সের সাথে। তারপর এটা-সেটা কাজ করেছি, ফাইন্যান্সেও কাজ করেছি। বিশেষ করে প্ল্যানিংয়ে কাজ করেছি বেশ কয়েক বছর।”

ঢাকার সেগুনবাগিচায় জাতীয় রাজস্ব ভবনে এক অনুষ্ঠানে বৃহস্পতিবার সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে বিদায় জানানো হয়। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

চাকরিজীবনে কর্মস্থল পরিবর্তন কম হওয়ার কারণে একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছেন বলে মনে করেন মুহিত।

“সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে প্রত্যেকের ক্যারিয়ার যদি দেখেন, দেখবেন প্রত্যেকের ২০/২৫টা করে পোস্টিং। আর আমার ক্যারিয়ারে দেখবেন ৩টা-৪টা পোস্টিং। এজন্য আমাকে ধন্যবাদ দিতে হবে তদানিন্তন যারা সিভিল সার্ভেন্টের উচ্চ পদে ছিলেন, তারা আমাকে একই লাইনে বহাল রাখেন। এরপর আমি প্ল্যানিং আর ফাইন্যান্সের বাইরে আর যাইনি।

“আমার সারাটা জীবনই, বাংলাদেশে তো এর বাইরে আর কাজ করি নাই। বিদেশি ছিলাম, সেখানে প্রধান কাজ ছিল প্ল্যানিং এবং ফাইন্যান্সের উপরই। এটাতে একটা সুবিধাও হয়েছে, আমি শুধু অভিজ্ঞতা পাইনি, একইসঙ্গে অনেক জ্ঞানও অর্জন করতে পেরেছি।”

২০০১ সালে আমি অবসরের চিন্তা করেছিলেন মুহিত; কিন্তু পরে তা থেকে সরে আসেন তিনি।

“তখন আমার মনে হল এটা অসময় চিন্তা। অনেক কিছুর স্বপ্ন দেখলাম এটা সেটা.. তার কোনো কিছুই অর্জন করা হয়নি। কিন্তু এখন আমার সেটা আর নেই।”

নতুনকে পরামর্শ

অনুষ্ঠানে বক্তব্যে মুহিত উত্তরসূরি মুস্তফা কামালকে কয়েকটি পরামর্শ দিয়ে যান, যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কর আদায় বাড়ানো নিয়ে।

করদাতা খুঁজে বের করতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দিয়ে ঢাকাসহ কয়েকটি বড় শহর এবং ঢাকার আশপাশে সরেজমিন সম্পদ জরিপ চালানোর পরামর্শ দেন তিনি।

মুহিত বলেন, “আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র রিক্রুট করেন। তারা আপনার জন্য একটি জরিপ করবে। তাদেরকে বলেন যে, বাড়ি দেখ, গাড়ি দেখ, লাইফস্টাইল দেখ। আর কিছুই করার দরকার নেই।

“ছাত্রদের বলবেন, ওনার কাছ থেকে জেনে নাও ওনারা কী বলেন। তারপর তোমাদের হিসাব মতো বলে দাও, উনি কত টাকার মালিক।”

কয়েকটি স্থানে এই জরিপের ভিত্তিতে কর আদায় করা হলে অন্য স্থানেও স্বপ্রণোদিত হয়ে অনেকে কর দিতে এগিয়ে আসবেন বলে মনে করেন মুহিত।

কর আহরণ বাড়ানোর ‘মানসিক লক্ষ্য’ ঠিক করার পরামর্শ দেন তিনি।

“এখন আমাদের রাজস্ব আদায় জিডিপির ১২ শতাংশের বেশি হবে না। পাঁচ বছরের জন্য একটা টার্গেট করেন। একটা যৌক্তিক পর্যায়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। আমার মনে হয় রাজস্ব বিভাগে এটি হবে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট একটি কাজ। আমি আপনার পেছনে আছি।”

নিজের অর্জন তুলে ধরতে গিয়ে মুহিত বলেন, “২০০৯ সালের দিকে আমরা যখন কাজ শুরু করি তখন কর বিভাগটি ভয়ংকরভাবে জনবিচ্ছিন্ন ছিল। এখন এটা নয়। এখন কর বিভাগে লোকজন আসে। লোকজন এটা মনে করেনা যে আমি করের জালে ঢুকে পড়লে আমাকে ওরা অনবরত জবাই করবে।

“আমরা যখন প্রথম আসলাম দেখলাম ৭ লাখ করদাতা। পরে হল ১৫ লাখ, সেখান থেকে আমরা টার্গেট করলাম ২৫ লাখ। এখন আমরা ৩০ লাখের বেশি চলে গেছি।”

“এখন আপনি টার্গেট করেন ১ কোটিতে যাবে, এটাও অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আমার মনে হয়, আপনার টার্মে এটা এক কোটির কাছাকাছি পৌঁছে যাবে,” নতুন অর্থমন্ত্রীকে বলেন পুরনো অর্থমন্ত্রী।

মুহিত আরও বলেন, “এই জিনিসটা মনে রাখবেন যে উই আর অ্যাডভান্সিং ইন অ্যা প্রসেস, এবং সে প্রসেসটাকে সামনের নিয়ে যাওয়া দরকার, যাতে এটা স্বয়ংক্রিয় প্রসেস হয়ে যায়।”

মুস্তফা কামাল দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে সংস্কার করে প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার উপর জোর দেন।

তিনি বলেন, “আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা বিশ্বের শীর্ষ ২০ অর্থনীতির দেশ হিসেবে জি টোয়েন্টিতে দাওয়াত পেয়ে অংশগ্রহণ করতে পারব বলে আমি আশাবাদী।”