শহরে জীবনযাত্রার ব্যয় আগের চেয়ে কম বেড়েছে; ক্যাব

রাজধানীর খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবার দাম বিশ্লেষণ করে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব বলেছে, বিদায়ী বছরে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আগের বছরের চেয়ে কম বেড়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Jan 2019, 09:06 AM
Updated : 12 Jan 2019, 10:25 AM

শিক্ষা, চিকিৎসা ও যাতায়াত ব্যয় বাদ দিয়ে জীবনযাপনের ব্যয় সংক্রান্ত প্রতিবেদন শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করে বেসরকারি সংগঠনটি।

ক্যাবের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান জানান, ঢাকা শহরের ১৫টি খুচরা বাজারের ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবা সংস্থার তথ্য নিয়ে এই পর্যালোচনা প্রতিবেদন তৈরি করেছেন তারা।

তিনি বলেন, “সদ্য সমাপ্ত ২০১৮ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ শতাংশ। পণ্যমূল্য ও সেবা সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ।

“পূর্ববর্তী ২০১৭ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ, পণ্যমূল্য ও সেবাসার্ভিসের মূল্য বেড়েছিল ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ।”

অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে গত বছর জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ পয়েন্ট কম।

ভোক্তার ঝুলিতে যেসব পণ্য ও সেবা রয়েছে সেসব পণ্য ও সেবা পরিবারের মোট ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করে পণ্য ও সেবার ওজনের ভিত্তিতে শহুরে জীবনযাত্রার ব্যয়ের এই হিসাব বের করেছে ক্যাব।

দেশের মোট জনসংখ্যার বড় অংশ গ্রামে থাকলেও নিজেদের সামর্থ্যের অভাবে ব্যয়ের সার্বিক চিত্র তুলে আনা সম্ভব হয়নি জানিয়েই ক্যাব চেয়ারম্যান বলেন, “শহুরে এই হিসাব সার্বিক চিত্র সম্পর্কে একটি আংশিক ধারণা দেবে।”

ক্যাবের পর্যবেক্ষণ, ২০১৮ সালে অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল ছিল। মোটা চালের দাম ১৫ শতাংশ, ডালের দাম গড়ে ১৭ শতাংশ, তেলের দাম ২ শতাংশ, মসলার দাম ২২ শতাংশ, শাক-সবজির দাম প্রায় ১১ শতাংশ এবং চিনির দাম ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ কমেছে।

২০১৮ সালে দাম বেড়েছে

ক্যাবের হিসাবে ২০১৮ সালে এর আগের বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে সাবানের। এই পণ্যটির দাম ২০ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া চালের গড় মূল্য ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ,  মাছের দাম ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ, শাক-সবজিতে ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ, পান-সুপারিতে ৭ দশমিক ১৮ শতাংশ, তরল দুধে ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ দাম বেড়েছে।

২০১৮ সালে দাম কমেছে

২০১৮ সালে এর আগের বছরের তুলনায় ডাল, লবণ, মসলা, চিনির দাম কিছুটা কমেছে। দেশি মসুর ডালে ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ, আমদানি করা মসুর ডালে ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ, আস্ত ছোলার দাম ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ, দেশি রসুন ২০ দশমিক ৫৩ শতাংশ, আমদানি রসুন ৩২ দশমিক ৩৭ শতাংশ কমেছে।

ভোজ্য তেল, গুঁড়ো দুধ, গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল ও রেলের ভাড়া এই বছর ছিল অপরিবর্তিত।

এই ব্যয়বৃদ্ধি যৌক্তিক কি না- সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে গোলাম রহমান বলেন, ব্যয় বৃদ্ধির এই হার ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন রকম ফল বয়ে আনতে পারে। ব্যয় অনুপাতে একজন ব্যক্তির আয় বৃদ্ধি না পেলে তো সেটা স্বস্তিদায়ক হবে না।

“আয় বৃদ্ধির ওপর আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। যদি ব্যয় বৃদ্ধির তুলনায় মানুষের আয় বৃদ্ধি হয় তাহলে সেটাই হবে স্বস্তিদায়ক।”

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বিগত বছর আমদানি শুল্ক বাবদ এক লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে ভোক্তাদের। এটি প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের তুলনায় অনেক বেশি। ভোক্তাদের উপর থেকে এই শুল্কের হার কমাতে হবে।

বাংলাদেশে আমদানি পণ্যের ওপর ২০১৭ সালে গড়ে ২৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। ২০১৬ সালে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে গড়ে শুল্ক ছিল ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ, কেবল দক্ষিণ এশিয়ায় এর হার ছিল ১২ দশমিক ১৯ শতাংশ।

ক্যাবের সুপারিশ

>> ধান-চালের মূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং কৃষককে উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত মূল্য দিতে পরীক্ষামূলকভাবে ‘কন্ট্রাক গ্রোয়িং পদ্ধতি’ অনুসরণ করে ধান কাটার মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি শস্য সংগ্রহ করা এবং শস্য বীমার প্রবর্তন করা।

>> ক্যাবের প্রস্তাব অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সংস্কার এবং ‘প্রাইস স্ট্যাবলাইজেশন ফান্ড‘ গঠন করে দেশে জ্বালানি তেলের দাম স্থিতিশীল রাখা। এলএনজি আমদানি সকল প্রকার শুল্ক-কর মুক্ত রেখে গ্যাসের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা।

>> চিকিৎসকদের ফিসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল্য নির্ধারণ, ওষুধের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ; বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সুলভে মানসম্মত চিকিৎসা সেবা প্রদান নিশ্চিত করা।

>> ওষুধ নীতি বাস্তবায়ন করা। বিএসটিআই ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে শক্তিশালী ও কার্যকর করা।

>> শিক্ষা খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করার লক্ষ্যে অবিলম্বে শিক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। শিক্ষার মান উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

>> খেলাপি ঋণ ঠেকাতে সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নিয়োগ পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে পর্ষদের জবাবদিহিতা বৃদ্ধি এবং আইনের সংস্কার করে দ্রুত খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করা।

>> আমদানি শুল্কের ব্যাপক হ্রাস এবং লবণসহ যে সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ অবিলম্বে সে সব পণ্যের অবাধ আমদানির সুযোগ সৃষ্টি করা।

>> দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তা-স্বার্থ সংরক্ষণে প্রণীত আইন ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, প্রতিযোগিতা আইন ২০১২, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫ এর বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

>> অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল যাতে সুষম বণ্টন হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা। আয় বৈষম্য নিয়ন্ত্রণের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের পদক্ষেপ গ্রহণ করা।