নতুন বছরে নতুন সরকারের প্রথম দিন থেকেই ব্যাংক খাতে নজর দেওয়ার তাগিদ এসেছে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে।
আমদানিতে উদ্বেগ ছাড়া ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো ছিল মোটামুটি ইতিবাচক। বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে যে টান পড়েছিল তা কেটে গেছে।
বছরের একেবারে শেষে এসে ৩০ ডিসেম্বর যে ভোট হয়েছে, তাতে আরও পাঁচ বছর দেশ শাসনের সুযোগ পেয়েছে গত এক দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ। ‘সমৃদ্ধির পথে অগ্রযাত্রা’ অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের ইশতেহারের মূল কথা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের বিচারে, নির্বাচনের বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ‘ভালোই’ গেছে।
তবে ব্যাংক খাতের সমস্যা যে রয়েই গেছে, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। সুশাসন নেই। নতুন বছরে নতুন সরকারকে এই দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি খাতে ব্যয় বেড়েছিল ২৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। সর্বশেষ অক্টোবর মাসের আমদানির পরিমাণ আগের বছরের অক্টোবরের চেয়ে ৪ শতাংশের বেশি।
আমদানি কমায় বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩২ বিলিয়ন ডলারের উপরে আছে। কিছুদিন আগে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বৃদ্ধির হারও আছে ইতিবাচক ধারায়। গত অর্থবছর রেমিটেন্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রেমিটেন্স বেড়েছে ১০ শতাংশের মত।
গত অর্থবছর রপ্তানি আয় বেড়েছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। আর এ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে সে গতি আরও বেড়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ দশমিক ২৪ শতাংশ।
অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক মূল্যস্ফীতি আছে সহনীয় অবস্থায়। পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
কিন্তু ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ২০১৮ সালে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। এ খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ এসেছে গত ১০ বছরে, সেগুলোর কোনো সুরাহাও হয়নি।
দশ বছর আগে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ১০ বছরে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৪ গুণ।
এর বাইরে দীর্ঘদিন আদায় করতে না পারা যেসব ঋণ ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে, তার পরিমাণ প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের সঙ্গে অবলোপন করা এ মন্দ ঋণ যুক্ত করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা।
বিশাল অংকের এই খেলাপি ঋণের পাশপাশি ব্যাংক খাতের ঋণ কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ কয়েক বছর ধরেই রয়েছে আলোচনায়। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা-সিপিডি তথ্য দিয়েছে, গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতের ১০টি বড় কেলেঙ্কারিতে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে।
এসব কেলেঙ্কারি ঘটেছে মূলত সরকারি ব্যাংকে। হল-মার্ক গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি দিয়ে সোনালী ব্যাংকের নাম এই কেলেঙ্কারিতে প্রথম এলেও সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ঘটেছে জনতা ব্যাংকে।বেসিক আর ফারমার্স ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনাও ব্যাংক খাতের আলোচিত ঘটনা।
জাতীয় নির্বাচনের ৩ সপ্তাহ আগে গত ৯ নভেম্বর ‘বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে আমরা কী করব’ শীর্ষক এক সংলাপে এই তথ্য দেয় সিপিডি। তবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ওই তথ্য ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে উড়িয়ে দেন।
তবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনায় বলা হয়, “ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার এবং দেউলিয়া আইন বাস্তবায়নের টেকসই ও কার্যকর পদ্ধতি নির্ণয় করা হবে। বাজার ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিচক্ষণতার সাথে নির্দিষ্ট পদ্ধতি ব্যবহার করে সুদের হার নিয়ন্ত্রণে রাখবে। ঋণ অনুমোদন ও অর্থছাড়ে দক্ষতা এবং গ্রাহকের প্রতি ব্যাংকের দায়বদ্ধতা পরিবীক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক পদক্ষেপ নেবে।”
“আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে যে তিনটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছে, সেই তিনটি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করলেই বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে যে উন্নয়ন হয়েছে তার চেয়েও বেশি গতি হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেটা পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।”
নিহাদ কবির বলেন, আওয়ামী লীগের ইশতেহারে দুর্নীতিতে ‘জিরো টলারেন্সের’ অঙ্গীকার রয়েছে। জনবান্ধব প্রশাসনের কথা বলা হয়েছে। আর সুসাশন নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
“এর সবগুলোই স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার সঙ্গে দ্রুত শুরু করতে হবে” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ব্যাংক খাতের অনেক সমস্যা আছে। মানুষ ব্যাংকের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে। সরকারকে এ খাত নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মখোমুখি হতে হয়েছে।আমি চাই বছরের শুরু থেকেই নতুন সরকার এ খাতের সুনাম ফিরিয়ে আনতে কাজ শুরু করে দিক।”