রাজনীতি এখন ব্যবসায় উদ্যোগ: দেবপ্রিয়

বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ব্যবসার একটি ‘কলুষ’ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Nov 2018, 01:14 PM
Updated : 22 Nov 2018, 06:31 PM

“নাগরিকরা এখন বুঝতে পারছেন না, কে রাজনীতিবিদ, আর কে ব্যবসায়ী? তাদের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে বাংলাদেশে রাজনীতি একটি বড় ব্যবসায় উদ্যোগ,” বলেছেন তিনি।

সংসদ নির্বাচনের আগে বৃহস্পতিবার ঢাকার মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে একথা বলেন গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয়।

ব্যবসায়ীদেরও রাজনীতিতে আসার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে আশঙ্কা রয়েছে, তা হচ্ছে নির্বাচনের ভিতরে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর যথেষ্ট দৃশ্যমান উপস্থিতি। ব্যবসায়ী গোষ্ঠী প্রয়োজন বোধ করছেন রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার। কারণ যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা অনেক ক্ষেত্রে তারা পেয়েছেন, সেটা একমাত্র রাষ্ট্রীয় আনুকুল্য দ্বারাই সেটা সম্ভব।

“কর অবকাশ থেকে, লাইসেন্স, একটি নতুন ব্যাংক করারচেষ্টাসহ এগুলো আনুকূল্যের ভিত্তিতে হয়েছে। সেজন্য তারা রাজনীতি দিয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে এটাকে সুরক্ষা দিতে চায়।”

ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের ‘কলুষ’ সম্পর্ক ভাঙতে দুটি পরামর্শ দেন দেবপ্রিয়; এর মধ্যে একটি নির্বাচনে আগে বাস্তবায়ন করতে হবে, অন্যটি নির্বাচনের পরে।

নির্বাচনের আগেরটি হল- ভোটের আগে যারা হলফনামা দিচ্ছেন সেগুলো দ্রুত রাজস্ব বোর্ডে দিয়ে মূল্যায়ন করিয়ে জনগণের সামনে তুলে ধরা।

নির্বাচনের পরেরটি হল- যারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন, তাদের যার যেখানে ব্যবসায়িক স্বার্থ আছে, সেখানে যেন নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব তাদের দেওয়া না হয়।

দেবপ্রিয় বলেন, “সাংসদরা যখনই শপথ নেবেন, সাথে সাথে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থগুলোকে ঘোষণা দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে।

তাদের একটি রেজিস্ট্রি তৈরি করতে হবে, যাতে লেখা থাকবে কোন কোন ব্যবসায় তার বা তার পরিবারের স্বার্থ জড়িত। এই স্বচ্ছতা আমাদের আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে না এলে আমাদের আইন প্রণয়ন ব্যবস্থায় ব্যক্তি স্বার্থ রয়ে যাবে।”

প্রতিযোগিতাপূর্ণ অর্থনীতির জন্য দেশে একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ রাজনীতি দরকার বলেও মন্তব্য করেন সিপিডির ফেলো।

তিনি বলেন, “একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ রাজনীতি যদি না থাকে, তাহলে একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ অর্থনীতি আশা করা বাতুলতা মাত্র।

প্রতিযোগিতা আনার ক্ষেত্রে দেশের উদ্যোক্তাদের নেতাদের ভূমিকা নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেন দেবপ্রিয়।

তিনি বলেন, উদ্যোক্তা শ্রেণি প্রভাবশালী হলেও তারা শক্তিশালী ব্যাংক ব্যবস্থা কার্যকর করতে পারছে না, বন্দরের অব্যবস্থাপনা দূর করতে পারছে না।

এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “তারা শ্রেণি স্বার্থ না দেখে ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করে। তারা নীতির ভিত্তিতে কাজ না করে বিষয়ের ভিত্তিতে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের ভেতরেও প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন পদ্ধতি অনেক সময় থাকে না।

এর ফলে তারা শক্তি নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার সাথে দরকষাকষি করতে পারে না।”

‘স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতিবেদন ২০১৮’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন দেবপ্রিয়।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মুল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজেম। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানও বক্তব্য রাখেন।

দেবপ্রিয় স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে মসৃণ উত্তরণে উদ্যোক্তা তৈরির জন্য কাঠামোগত পরিবর্তনের উপর জোর দেন দেবপ্রিয়।

তিনি বলেন, “স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণই উন্নয়নের শেষ কথা নয়। এটা হল উন্নয়নের কাহিনীর একটি অঙ্ক মাত্র। এই উন্নয়ন থেকে আরও উন্নত নাটকীয় অঙ্কে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি দরকার। এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্যও একটি মসৃণ পথও আমাদের তৈরি করতে হবে।”

দেবপ্রিয় বলেন, “উদ্যোক্তাদেরই আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী হওয়ার কথা। তাদের প্রবৃদ্ধি এবং মুনাফাতে আগ্রহী হওয়ার কথা।

“সুশাসন আনার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার একটা প্রতিযোগিতাপূর্ণ অর্থনীতি। কিন্তু তার পরিবর্তে যদি নিদির্ষ্ট সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়, সুবিধাভোগী ব্যক্তি উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয়, তাহলে সে প্রতিযোগিতাপূর্ণ অর্থনীতি কর্মক্ষম হয় না।”

কাঠামোগত পরিবর্তনের উদাহরণ দিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, “শিল্প খাতের ভূমিকা বাড়বে, কৃষিতে কর্মসংস্থান কমে আরও উৎপাদনশীল খাতে কৃষকরা যাবে। আমাদের সে সমস্ত সেবাখাত আছে সেগুলোতে পাইকারি আর খুচরা বিক্রেতাদের থেকে আমরা উন্নত মানের সেবা দিতে পারব। সেবা খাতে বিনিয়োগ হবে। একই সাথে দেশের ভিতরে বৈষম্য কমবে।”

“স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণে আমরা উচ্ছ্বসিত। কিন্তু এখানে আত্মপ্রসাদের কিছু নেই। কারণ দীর্ঘ উন্নয়ন যাত্রা আমাদের এখনও রয়ে গেছে,” সতর্ক করেন তিনি।

মোস্তাফিজুর বলেন, “আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের দিকে যাচ্ছি। তাই আমাদের এখন নতুন বাজার খুঁজতে হবে। চীন ও ভারত হতে পারে সেই বাজার।”

মূল প্রবন্ধে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “বাংলাদেশে অর্থনীতিরি জন্য যেসব আইনি কাঠামো তৈরি করা হয়, তাতে বড় ব্যবসায়ীরাই সুবিধা পায়। ছোট ছোট উদ্যোক্তা তৈরিতে কোনো ভূমিকা তা রাখতে পারছে না। অথচ আমাদের উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশ হতে হলে ছোট উদ্যোক্তা তৈরিতেই সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হতে হবে।”

দেশে ছোট উদ্যোক্তা তৈরি পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে প্রয়োজনীয় নীতি কাঠামো প্রণয়নে গুরুত্বও দেন তিনি।