নতুন একটি ব্যাংক অনুমোদন, ৩টিকে ‘না’

পুলিশের কমিউনিটি ব্যাংককে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিবেচনায় থাকা বাকি তিনটি ব্যাংকের অনুমোদন ‘এই মূহুর্তে’ দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Oct 2018, 04:53 PM
Updated : 29 Oct 2018, 04:53 PM

সরকারের মেয়াদের শেষ সময়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করতে চারটি ব্যাংকের উদ্যোক্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে কিছুদিন আগে কমিউনিটি ব্যাংককে প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।

সোমবার রাতে গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় পুলিশের ব্যাংকটির কার্যক্রম শুরুর চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।

কমিউনিটি ব্যাংক চালু করার প্রস্তাব করেছিল বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট (বিপিডব্লিউটি)।

এটি কার্যক্রম শুরু করলে বাংলাদেশে মোট ব্যাংকের সংখ্যা হবে ৫৯।

যে তিনটির আবেদন অনুমোদন না করে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে সেগুলো হচ্ছে বেঙ্গল ব্যাংক, পিপলস ব্যাংক ও সিটিজেন ব্যাংক।

সভা শেষে  বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এবং মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বোর্ড সভায় কমিউনিটি ব্যাংককে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বাকি তিনটি ব্যাংকের প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়নি।

কেন দেওয়া হয়নি- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “বেঙ্গল ব্যাংকের আবেদনে যে পরিচালকদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে তিনজনের বিরুদ্ধে করসংক্রান্ত মামলা থাকায় অনুমোদন দেওয়া হয়নি।”

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের কোনো পরিচালক আদালতের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত হলে তিনি আর ওই ব্যাংকের পরিচালক থাকতে পারবেন না।

“যেহেতু আবেদন করা বেঙ্গল ব্যাংকের তিন উদ্যোক্তা পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা আছে সেহেতু তাদেরকে পরিচালক রাখলে কোনো অবস্থাতেই ব্যাংকটির অনুমোদন দেওয়া সম্ভব নয়,” বলেন সিরাজুল ইসলাম।

পিপলস ব্যাংকটির আবেদনে প্রস্তাবিত চেয়ারম্যান ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা এম এ কাশেম।

এই ব্যাংকটির অনুমোদন না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, “বোর্ড সভায় এম এ কাশেমের যুক্তরাষ্ট্রের যাবতীয় সম্পদের হিসাব চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।”

আবেদনে কাশেম সম্পদের যে হিসাব দিয়েছে তা যথাযথ নয় বলে মনে করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।”

সিটিজেন ব্যাংক যে আবেদন করেছে তাতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় অনুমোদন দেওয়া হয়নি বলে জানান সিরাজুল ইসলাম।

যে তিনটি ব্যাংকের আবেদন অনুমোদন না দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে, সেগুলোর পৃষ্ঠপোষকরা নানাভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট।

বেঙ্গল ব্যাংক চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল দেশীয় প্লাস্টিক পণ্য প্রস্ততকারক প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোর্শেদ আলম এই গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং প্রস্তাবিত ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হলেন তার ছোট ভাই জসীম উদ্দিন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মা জাহানারা হকের নাম সিটিজেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছিল।

গত বছর অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে চাপ আসা সত্ত্বেও নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার প্রস্তাবটি স্থগিত রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক।

অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকাররা নতুন ব্যাংকের বিষয়ে বরাবরই বিরোধিতা করে বলছেন, বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে গেছে। বর্তমান অবস্থায় দেশে আর ব্যাংকের প্রয়োজন নেই।

তারা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা এমনিতেই খারাপ। এ পরিস্থিতিতে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া কোনোভাবেই উচিৎ হবে না।

কিন্তু অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ক্রমাগত আসতে থাকা চাপে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিরোধ টিকতে পারেনি।

অর্থমন্ত্রী সর্বশেষ গত ২৫ সেপ্টেম্বরও এক চিঠিতে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে দেওয়া এক চিঠিতে মুহিত লিখেন, “সম্ভবত, বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি প্রস্তাবিত একটি ব্যাংককে লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি আপনাকে প্রস্তাবিত সবগুলো ব্যাংককে একে একে লাইসেন্স দেওয়ার অনুরোধ করছি।”

চিঠিতে অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘‘সম্প্রতি এক বৈঠকে প্রস্তাবিত ব্যাংকগুলোকে লাইসেন্স প্রদানে সম্মত হয়েছেন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও উপস্থিত ছিলেন।”

তবে তার একদিন আগে অর্থাৎ গত ২৪ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, “দেশের ব্যাংক খাত খুব বেশি বড় হয়ে গেছে। আর্থিক খাতের চাহিদার তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি বলে ব্যাংকাররাই মনে করছেন। তাই এ খাত সংকোচনের দরকার হতে পারে।”

বাংলাদেশে এখন সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৫৮টি বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে, ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৪টি।

আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে ২০১২ সালে নয়টি বেসরকারি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় ওই ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দেওয়া নিয়ে সে সময় সমালোচনা হয়।

ঋণ কেলেঙ্কারির কয়েকটি বড় ঘটনায় গত কয়েক বছর ধরেই দেশের ব্যাংক খাত আলোচনায় রয়েছে। সর্বশেষ অনুমোদন পাওয়া কয়েকটি ব্যাংকও অনিয়ম আর তারল্য সঙ্কটে ধুকছে।

গত জুন পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার (রাইটঅফসহ) মত, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১৫ শতাংশ।

এই বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ নিয়ে দেশে অর্থনীতিবিদদের যেমন উদ্বেগ আছে, তেমনি তিন সপ্তাহ আগে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফ বার্ষিক সম্মেলনে বিভিন্ন বৈঠকেও এ বিষয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় মুহিতকে।

সে সময় তিনি বলেছিলেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদ যেহেতু শেষ হয়ে আসছে, সেহেতু তিনি এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে যাবেন, যাতে পরবর্তী সরকার এসে এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে।

আরও খবর