ঋণ খেলাপির সংস্কৃতি জিয়ার আমলে শুরু: রেহমান সোবহান

অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেছেন, এখন বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে গেলেও এর শুরুটা হয়েছিল সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 June 2018, 11:44 AM
Updated : 24 June 2018, 01:10 PM

রোববার সিপিডি আয়োজিত ‘বাজেট ডায়ালগ ২০১৮’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে  ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনার এক পর্যায়ে একথা বলেন তিনি।

সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, “বাংলাদেশে আজকে ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা ও খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি, এটা এই সরকারের সৃষ্টি নয়। বরং এটা অনেক বছরের জিইয়ে রাখা একটা সমস্যা।

“সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমল থেকে এটার শুরু। এরপর থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এ সমস্যা আজ প্রকট আকার ধারণ করেছে।”

১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ক্ষমতায় বসেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়া। তার মৃত্যুর পর এইচ এম এরশাদের সামরিক শাসনে ছিল বাংলাদেশ। ১৯৯০ সালে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র ফেরে বাংলাদেশে।

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে এখন দুই অঙ্কের কোঠা (মোট বিতরণ করা ঋণের) অতিক্রম করেছে, যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বঙ্গবন্ধু আমলের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য রেহমান সোবহানও বলেন, খেলাপি ঋণের বর্তমান হার ব্যাংক খাতের জন্য ‘গভীর উদ্বেগের বিষয়’।

বর্তমানে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই খেলাপি ঋণের মধ্যে প্রকৃত খেলাপি ঋণ হচ্ছে ৮০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৪৫ হাজার কোটি টাকা অবলোপন (রাইট অফ) করা; যা পাওয়ার আশা নেই বললেই চলে।

রেহমান সোবহান দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করার জন্য আর্থিক খাতের অবকাঠামোগত সংস্কারের পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, “দেশে দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। খেলাপি ‍ঋণ আমাদের আশঙ্কা নয়, বরং আর্থিক খাতের কাঠামোর ধরন নিয়েই আমাদের শঙ্কা।”

মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জনে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে কাজ করে যাওয়ার পরামর্শ দেন রেহমান সোবহান।

তিনি বলেন, “মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েই ক্ষান্ত হলে হবে না। আমাদের গতিশীল কর্মকাণ্ড দিয়ে দেশকে আরও উন্নত করার তাগিদ থাকতে হবে।

“ভিয়েতনাম প্রায় আমাদের সমান সম্পদ নিয়ে কতটা উন্নতি করেছে, আমরা তা পারিনি। আমরা যেখানে এখনও মাত্র ৪০ বিলিয়ন রপ্তানি করি, সেখানে ভিয়েতনাম করে ২০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।”

২০১৭ সালে প্রায় ভিয়েতনামের ৩৮ শতাংশ বৈদ্যুতিক পণ্য রপ্তানির তথ্য তুলে ধরে তিনি পণ্যের বাজারে বহুমুখীকরণের উপর জোর দেন।

ঢাকার লেইক শোর হোটেলে এই অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক অডিটর জেনারেল এম হাফিজ উদ্দিন খান, মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি নিহাদ কবির, গণ স্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও সাবেক সচিব সোহেল আহমেদ চৌধুরী আলোচনা করেন।

বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী

সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু ব্যাংক খাতে অনিয়মের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “আমাদের যে একটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ আছে, এটা বিলুপ্ত করে দেওয়া উচিত।”

তিনি বলেন, “দেশের ৫ শতাংশ লোকের কাছে বেশির ভাগ সম্পদ জমা হচ্ছে। প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হচ্ছে।  এসব অর্থ কারা নিচ্ছে, তা কি সরকার জানে না? অবশ্যই জানে।”

বিদেশে যারা সম্পদ কিনছে, তাদের সেই সম্পদের উপরও কর বসানোর প্রস্তাব করেন বিএনপি নেতা আমীর খসরু।

ব্যাংক খাত নিয়ে সমালোচনার জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেন, “শিগগির আমরা ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সংস্কার শুরু করব। আপনারা শুনবেন। মাস দুয়েকের মধ্যে এটা হতে পারে।”

পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল

ব্যাংক ঋণে অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির হিসেবে ফারমার্স ব্যাংকের ১০-১২ জন কর্মকর্তার কারাগারে যাওয়ার কথা বলেন তিনি।

প্রস্তাবিত বাজেটে কর্পোরেট হার কমানোর সমালোচনার জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, বিনিয়োগ বাড়ানো ও ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

দেশে বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “বর্তমানে দেশে জিডিপির ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ বিনিয়োগ হচ্ছে। পৃথিবীর ৫৮তম সেরা অর্থনীতি থেকে গত ১০ বছরে আমরা ৪২তম অর্থনীতির দেশ হয়েছি।”

অর্থ প্রতিমন্ত্রী মান্নান বলেন, “জনগণ আমাদের গ্রহণ করেছে। বিশেষ রাজনৈতিক দল জনগণকে রাস্তায় নামার আহ্বান করলেও তারা নামেনি।”

অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান

সাবেক আমলা মান্নান বলেন, “অনেকে সরকারের সমালোচনা করেন সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতা দেওয়া হয় না বলে। কিন্তু সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগেুলোকে স্বাধীনতা দিলেও তারা স্বাধীন থাকতে চায় না।

“আমি দেখেছি, যতই স্বাধীনতা দেওয়া হোক না কেন, রাত পোহালে দেখা যায়, সচিব সাহেবের ঘরে এসে হাঁটাহাটি করা হয়। কেন? রিটায়ারমেন্টের পরে পাঁচ বছর এক্সটেনশন চাই, অন্যান্য ভালো জব চাই। এগুলো আমার বাস্তব কথা। সুতরাং স্বাধীনতা দিলেই তার ব্যবহার করবে, তার গ্যারান্টি নাই।”