নিহত ও অক্ষম জেলেদের প্রণোদনায় সরকারি নীতিমালা

মাছ ধরতে গিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও জলদস্যুদের আক্রমণ এবং হিংস্র প্রাণীর আক্রমণে নিহত অথবা স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলে ও তার পরিবারের জন্য সরকারি প্রণোদনার প্রস্তাব করে একটি নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করেছে সরকার।  

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকশহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 June 2018, 05:34 AM
Updated : 15 June 2018, 05:50 AM

এই নীতিমালা ‘সমগ্র বাংলাদেশে মৎস্য আহরণকালে নিহত বা নিখোঁজ জেলে পরিবার বা স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলেদের জন্য’ প্রয়োজ্য হবে।

আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা থেকে নীতিমালাটি জারি করা হবে বলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ জানিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মৎস্য অধিদপ্তরের নিবন্ধিত ও পরিচয়পত্রধারী জেলে মাছ ধরার সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলদস্যুদের হামলা বা বাঘ, কুমির, সাপের কামড়ে মারা গেলে তার পরিবাকে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা দেওয়া হবে।

মাছ ধরার সময় দুর্ঘটনায় স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলেদের ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান দেওয়া হবে বলেও জানান মন্ত্রী।

মৎস্য অধিদপ্তরের আওতাধীন ’জেলেদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১২-১৩ হতে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত নিহত জেলে পরিবারকে সরকারি অনুদান দেওয়া হয়েছিল।

রাজস্ব বাজেট হতে এ আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখা ও প্রকৃত জেলে পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য এই নীতিমালা প্রণয়ন সমীচীন বলে মনে করছে সরকার। 

নিহত জেলে পরিবার বা স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলেদের প্রণোদনা সহায়তা প্রদান নীতিমালা- ২০১৮ এর উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, “জলাশয়ে মাছ ধরার সময় ঝড় সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাতের কারণে ও জলদস্যুদের হামরায় বা বাঘ, হাঙ্গর, কুমির বা হিংস্র জলজ প্রাণির আক্রমণে নিবন্ধিত নিহত, নিখোঁজ বা স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলেকে আর্থিক সহায়তা প্রদাদের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও জীবিকার ঝুঁকি হ্রাস করা।”

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের এক কোটি ৮৫ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্যখাতের উপর নির্ভরশীল। মাছ ধরা ছাড়া তাদের জীবিকার বিকল্প উৎস নেই। এমনকি মাছ ধরার জাল ও নৌকা কেনারও সামর্থ্য নেই অনেকের।

দেশের মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং মোট কৃষিজ জিডিপির ২৪ দশমিক ৪১ শতাংশ মৎস্য খাত থেকে আসে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী বলেন, “বেশিরভাগ জেলে পরিবার আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল। তারা যখন নদীতে মাছ ধরতে যায় তখন অনেক পরিবারের সদস্যরা মানবেতন জীবনযাপন করে।

“যখন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মারা যায় বা উপার্জনের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখন ওই পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। এজন্য জেলে পরিবারকে অনুদান দেওয়ার জন্য নীতিমালা করা হচ্ছে।”

সহায়তা পাওয়ার শর্ত

খসড়া নীতিমালায় নিহত জেলে পরিবার বা স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলেদের সহায়তা পাওয়ার পাঁচটি শর্ত দেওয়া হয়েছে।

>> নিহত, নিখোঁজ বা স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলেকে অবশ্যই মৎস্য অধিদপ্তরের আওতায় নিবন্ধিত এবং জাতীয় পরিচয়পত্রধারী হতে হবে।

>> জলাশয়ে মাছ ধরার সময় ঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাতের কারণে ও জলদস্যুদের হামলায় বা বাঘ, হাঙ্গর, কুমির বা হিংস্র জলজপ্রাণির আক্রমণে নিহত, নিখোঁজ জেলে পরিবার বা স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলে।

>> মৎস্য আহরণকালে নিহত বা নিখোঁজ জেলের মৃত্যুর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা পৌরসভার কাউন্সিলন কর্তৃক প্রদত্ত মৃত্যু সনদ বা নিখোঁজ প্রত্যয়নপত্র থাকতে হবে।

>> স্থায়ীভাবে অক্ষমতা স্বপক্ষে আবেদনে সংযুক্ত ছকে মেডিকেল বোর্ডের সনদপত্র।

>> নিহত বা নিখোঁজ জেলে পরিবারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত বা স্থায়ীভাবে অক্ষম হওয়া জেলেকে তিন মাসের মধ্যে স্থানীয় উপজেলা মৎস্য অফিসে আবেদন করতে হবে।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ‘জেলেদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান’ প্রকল্পের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ১৬ লাখ ২০ হাজার জেলেকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে।

এরমধ্যে ১৪ লাখ ২০ হাজার জেলেকে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে।

সব জেলেকেই নিবন্ধনের আওতায় এনে পরিচয়পত্র দেওয়া হবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

যেভাবে মিলবে অনুদান

খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কাছে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা পৌরসভার কাউন্সিলরের দেওয়া উত্তরাধিকারদের মধ্য থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত সদস্য বা স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলেকে নির্ধারিত ছকে আবেদন করতে হবে।

আবেদনের সঙ্গে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা পৌরসভার কাউন্সিলরের দেওয়া নিহত জেলের মৃত্যু সনদ, নিখোঁজ জেলের প্রত্যয়নপত্র এবং স্থায়ীভাবে অক্ষমতার স্বপক্ষে মেডিকেল বোর্ডের সনদ দিতে হবে।

জলদস্যুদের দ্বারা নিহত বা নিখোঁজ হলে পরিবারকে স্থানীয় থানায় জিডি করে এর কপি আবেদনের সঙ্গে দিতে হবে। জেলেদের পরিপত্র ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি আবেদনের সঙ্গে দিতে হবে।

আবেদনের পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে উপজেলা আর্থিক সহায়তা প্রদান সংক্রান্ত কমিটিকে সভা করে সুপারিশ আকারে তা জেলা আর্থিক সহায়তা প্রদান সংক্রান্ত কমিটিতে পাঠাতে হবে।

জেলা পর্যায়ে আর্থিক সহায়তা প্রদান সংক্রান্ত কমিটি আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন করবে। এই কমিটি ১৫ দিনের মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের তালিকাসহ অনুদানের চাহিদা পাঠাবে।

মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জেলা কমিটির সুপারিশকৃত তালিকা ও চাহিদা অনুযায়ী ১৫ দিনের মধ্যে বাজেটে বরাদ্দ থাকা সাপেক্ষে সরাসরি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে বরাদ্দ দেবেন।

এই বরাদ্দ পাওয়ার পর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে ১৫ দিনের মধ্যে অনুমোদিত আবেদনকারীরর অনুকূলে চেক হস্তান্তর করতে হবে।

জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে জেলা কমিটিতে পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জন, জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাস কর্মকর্তা, জেলা সমবায় কর্মকর্তা এবং জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মনোনীত মৎস্যজীবী সমিতির দুইজন প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে রয়েছেন।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এই কমিটিতে সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।

অন্যদিকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে উপজেলা আর্থিক সহায়তা প্রদান সংক্রান্ত কমিটিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, থানার ভারাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা এবং উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মনোনীত দুইজন মৎস্যজীবী প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে থাকবেন।

উপজেলা কমিটিতে উপজেলা/সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।