সুদ মেটাতেই ৫১ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা

বর্তমান সরকারের শেষ বাজেটে রাজস্ব ব্যয়ের যে ফর্দ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তৈরি করেছেন তাতে ৫১ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকাই চলে যাবে ঋণের সুদ পরিশোধে।

আবদুর রহিম হারমাছিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 June 2018, 02:38 PM
Updated : 9 June 2018, 02:41 PM

এই অঙ্ক রাজস্ব বাজেটের ১৮ শতাংশেরও বেশি।

সরকারের এই বিশাল অঙ্কের সুদ গুণতে হওয়ার জন্য কয়েক বছর ধরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অনেক বেড়ে ‘ঋণের বোঝা ভারি’ হওয়ার কথা বলছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী মুহিত। চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেটে রাজস্ব ব্যয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা।

এর মধ্যে ৫১ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা বা ১৮ দশমিক ০১ শতাংশই খরচ হবে সরকারের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধে। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ মেটাতে ব্যয় হবে ৪৮ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। আর বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে চলে যাবে ২ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা।

 

বিদায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের মূল বাজেটে সুদ পরিশোধের জন্য রাখা হয়েছিল ৪১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৩৭ হাজার ৯২০ কোটি টাকায় নামিয়ে এনেছেন অর্থমন্ত্রী।

এই ঋণের বোঝা কমাতে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর কথা বলেছেন।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মূলত সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হওয়ার কারণেই সরকারের ঋণের বোঝা বেড়েছে। আর সেই বোঝার সুদই এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে বাজেটের মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে।”

তার মতে, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি হওয়ার কারণেই এর বিক্রি বেড়েছে।

“ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার যেখানে ৪ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ছিল, সেখানে সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার ১২ থেকে ১৩ শতাংশের মধ্যে। আর সে কারণেই সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ এই সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকেছে মানুষ। যার সঞ্চয় ছিল সে-ই সঞ্চয়পত্র কিনেছে।”

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ৭৫ হাজার ১৩৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়।এর মধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ পূর্তির কারণে আসল পরিশোধ করা হয়েছে ২২ হাজার ৭১৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা। আর সুদ বা মুনাফা শোধ করা হয়েছে ১৫ হাজার ৮১৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।

বিদায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) মোট ৬০ হাজার ১২৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। মেয়াদ পূর্তির পর গ্রাহকরা আসল তুলে নিয়েছেন ৮ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা।

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

ফাইল ছবি

এ পরিস্থিতিতে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার জুলাই মাসে পর্যালোচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

শুক্রবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি বলেছি, (সঞ্চয়পত্রে) যে মুনাফা পাওয়া যায় সেটা নিয়ে সভা দিয়েছিলাম, সভা করতে পারিনি।”

সবশেষ ২০১৫ সালের ১০ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ হার গড়ে ২ শতাংশ কমানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেনি।

সঞ্চয়পত্রের সুদের হার দুই-তিন বছর পর পর পর্যালোচনা করার কথা জানিয়ে মুহিত বলেন, “এবার একটু দেরি হয়েছে, পরের মাসে রিভিউ হবে।”

সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যাচ্ছে বলে গত বছরও (২০১৭ সালের মে মাসে)  বাজেটের আগে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু পরে বাজেট অধিবেশনে মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা অর্থমন্ত্রীর ওই ঘোষণার তীব্র সমালোচনা করায় শেষ পর্যন্ত আর সুদের হার কমানো হয়নি।

তবে বাজেট ঘাটতি মেটাতে বিদায়ী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে যে পরিমাণ অর্থ ধার করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল, সরকার তার চেয়ে ৩৩ শতাংশ বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে এপ্রিল মাসের মধ্যেই।

এ পরিস্থিতিতে গত মে মাসে বাজেটপূর্ব এক আলোচনায় অর্থমন্ত্রী বাজেটের পর সঞ্চয়পত্রের সুদ হার সমন্বয় করার কথা বলেছিলেন।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি দেখানো হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা।

এই ঘাটতি মেটাতে সরকারকে দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ ২১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা ঋণ নিতে হবে। এর মধ্যে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা এবার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ করার পরিকল্পনা ঠিক করেছেন মুহিত।

অন্যান্য খাতে ব্যয়

২০১৮-১৯ অর্থবছরের রাজস্ব বাজেটের অন্যান্য খাতের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায় ব্যয় হবে ৫৮ হাজার ৫১২ কোটি টাকা। শতাংশ হিসেবে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থই চলে যাবে এই খাতে।

ভর্তুকি ও প্রণোদনা, অবসর ভাতা, সাহায্য মঞ্জরিতে ব্যয় হবে ১ লাখ ৬ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা।

এছাড়া পণ্য ও সেবা খাতে ব্যয় হবে ৩০ হাজার ৭৮ কোটি টাকা।