নবীন বাংলাদেশের জন্য প্রবীণ বাজেট: সিপিডি

নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আয়-ব্যয়ের যে লক্ষ্য ঠিক করেছেন, তাতে উচ্চবিত্ত সুবিধা পেলেও নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ওপর চাপ বাড়বে বলে মনে করছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 June 2018, 09:12 AM
Updated : 8 June 2018, 05:10 PM

সেই সঙ্গে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট কর কমানোর প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করেছে বেসরকারি এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

শুক্রবার বাজেট পরবর্তী পর্যালোচনায় বেসরকারি এ গবেষণা সংস্থার সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সামগ্রিক বিবেচনায় তাদের মনে হয়েছে, “নবীন বাংলাদেশের জন্য একটি প্রবীণ বাজেট তৈরি করা হয়েছে।”

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরেছেন, তাতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা।

ফলে আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৯ শতাংশ।  অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে এই ঘাটতি পূরণের পরিকল্পনা করেছেন মুহিত।

মুহিত আশা করছেন, এ বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে আসন্ন নতুন অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে। আর তা করা সম্ভব হবে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রেখেই।

বাজেটের এই লক্ষ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে দেবপ্রিয় বলেন, প্রবৃদ্ধির জন্য বাজেটে বিনিয়োগের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা পূরণ করতে হলে ১১৭ হাজার কোটি টাকা বাড়তি লাগবে, যা ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ করতে হবে।

আর তাতে করে ‘পুঁজির উৎপাদনশীলতা কমে যাবে’ বলে মন্তব্য করেন সিপিডিরি সম্মানীয় ফেলো।

তিনি বলেন, “ধরা হয়েছে যে মূল্যস্ফিতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ থাকবে, আমরা অবশ্যই এটার ব্যাপারে গভীর সংশয় প্রকাশ করছি। কারণ বিশ্ব অর্থনীতির যে পরিস্থিতি এবং দেশের ভেতরে যে প্রবণতা সেটা এটাই বলছে।”

প্রবৃদ্ধির অংকের বদলে সেই প্রবৃদ্ধি মানুষের জীবন মানে কতটা পরিবর্তন আনতে পারছে- সে দিকে নজর বাড়ানোর তাগিদ দেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

“আমরা বার বার বলেছি যে, বিড়াল বড় হতে পারে, বিড়াল ছোট হতে পারে কিন্তু তাকে ইঁদুর ধরতে হবে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির হার উঁচু হতে পারে, প্রবৃদ্ধির হার নিচু হতে পারে, কিন্তু প্রবৃদ্ধিতে গরীব মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন হতে হবে, তাদের বেশি পেতে হবে।

“কিন্তু আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে পূর্ব-পশ্চিম ভাগ তৈরি হয়েছে। এক দিকে সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা; অপর দিকে বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী। একদিকে উন্নততর বাংলাদেশ, আরেকদিকে দরিদ্রতর বাংলাদেশ।… আমরা দেখছি, সম্পদ, ভোগ এসব ক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়েছে।”

অর্থনীতির এই গবেষক বলেন, যারা সবচেয়ে গরীব, গত পাঁচ বছরে তাদের ৬০ শতাংশ আয় কমেছে। অন্যদিকে সবচেয়ে ধনী পাঁচ শতাংশ মানুষের ৫৭ দশমিক ৪ শতাংশ আয় বৃদ্ধি ঘটেছে।

“এখানে যার পুঁজি আছে, তারা আয় করার বেশি সুযোগ পাচ্ছে যার শ্রম ও উদ্যোগ আছে তার তুলনায়। শ্রম ও উদ্যোগের তুলনায় পুঁজি এবং সম্পদকে বেশি পুরস্কৃত করছেন। এটা মেধা ভিত্তিক অর্থনীতির জন্য ভালো খবর বলে মনে হচ্ছে না।”

দেবপ্রিয় বলেন, প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, রেমিটেন্স, রপ্তানি আয়, মুদ্রাস্ফীতি ও সামাজিক সুরক্ষার জায়গাগুলোকে দেশের অর্থনীতির শক্তিশালী দিক।

পাশাপাশি রাজস্ব আদায় ও এডিপি বাস্তবায়নে দুর্বলতা, কৃষকের প্রণোদনামূলক দাম না পাওয়া, বৈদিশিক আয়-ব্যয়ে চাপ ও খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিকে তিনি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। 

তিনি বলেন, ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ এখনও স্থবির হয়ে রয়েছে। কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধির হার এবং গরিবের আয় বৃদ্ধির হার দুর্বল, উৎপাদনশীলতা ও মানবসম্পদের গুণগত মান দুর্বল। এ কারণ বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাজেটে ব্যক্তিখাতে করমুক্ত আয়ের সীমা না বাড়ানোয় হতাশা প্রকাশ করে দেবপ্রিয় বলেন, “আনুতোষিক ব্যয়ে ৭৫ লাখ টাকা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সেটা উচ্চবিত্তের মানুষরা পাবেন। এটা আমাদের কাছে বৈষম্যপূর্ণ মনে হয়েছে। যখন নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তকে সুবিধা দিলাম না, কিন্তু উচ্চবিত্তকে আনুতোষিক ব্যয়ে সুবিধা দিচ্ছি, এটা অর্থনীতির সাম্যনীতিতে ঠিক হল না।”

অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেটে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের করপোরেট ট্যাক্স বিদ্যমান ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রস্তাব করেছেন। আর অনিবন্ধিত ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের করপোরেট ট্যাক্স বিদ্যমান ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন।

এর বিরোধিতা করে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো বলেন, “ব্যাংক খাতে যে ধরনের নৈরাজ্য চলছে, সেটা সমাধান না করে এ ধরনের সুবিধা দেওয়া… আগে যেভাবে পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেটাকে ধরে রাখা হয়েছে। এরপরেও তারল্য বাড়বে না বলেই আমাদের সন্দেহ।”

কর কমানোর কারণে বিনিয়োগ বাড়বে- এমন যুক্তি প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য যেসব প্রতিবন্ধকতার কথা বলেন, সেগুলোর মধ্যে কর হার নেই। সেখানে দুর্নীতি, আমলাতন্ত্র, অবকাঠমো সমস্যা, বিভিন্ন ধরণের প্রশাসনিক সমস্যা এবং অনিশ্চয়তা। কিন্তু তার ভিতরে কর হারের কোনও সমস্যা নেই।”

এক প্রশ্নের উত্তরে দেবপ্রিয় বলেন, বাজেটে নিম্ন আয়ের মানুষকে সুবিধা দিতে যেমন সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানোর কথা বাজেটে আছে, তেমনি যারা নির্বাচনে অর্থায়ন করেন তাদেরও সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

“নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা বহুল পরিমাণে গরিব মানুষের প্রয়োজন অনুভব করেন ভোটের রাজনীতিতে। ভোটের রাজনীতিতে অর্থের প্রয়োজনে বিত্তশালীদের ভূমিকার প্রয়োজন বোধ করেন। কিন্তু বিকাশমান মধ্যবিত্তের ভূমিকাকে এখনো মূল্যায়ন করেন না।”

ছোট আকারের ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে বাজেটে দেড় শতাংশ থেকে ২ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাবেরও সমালোচনা করেন দেবপ্রিয়। 

তিনি বলেন, “চাপগুলো কিন্তু মধ্যবিত্ত এবং নিম্ম মধ্যবিত্তদের ওপরেই পড়ছে।”

সিপিডি মনে করছে, এবারের বাজেটের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) পুরনো প্রকল্পের ভারে ‘ভারাক্রান্ত’। সেইসঙ্গে অতিরিক্ত নতুন প্রকল্প অনুমোদনের ফলে প্রকল্পের ভার অনেক বেশি হয়ে গেছে।

“আগামী বছরের জন্য এক হাজার ৩৪৭টি প্রকল্প তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। যুক্ত হবে নতুন আরও প্রকল্প। ৬৪টি প্রকল্পে নামে মাত্র এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে। অথচ এ প্রকল্পগুলোর গড় বয়স চার বছর। সেগুলো এক থেকে চারবার সংশোধন করা হয়েছে।”

বাজেট পাস করার সঙ্গে সঙ্গে বাজেট বাস্তবায়নে একটি পরিকল্পনা নেওয়ার তাগিদ দিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, টাকা খরচ করলেই বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে ধরে নেওয়ার প্রবণতা থেকে সরে আসতে হবে।  বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি ফলাফলভিত্তিক পরিবীক্ষণ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা দরকার, যাতে উন্নয়নের সুফল কাজে লাগছে কি না তা নিশ্চি হয়।

রাজধানীর লেকশোর হোটেলে এ অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। অন্যদের মধ্যে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার মোয়াজ্জেম হোসেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।