তারা বলছে, প্রবৃদ্ধি, উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও আয় এই চারটি সূচকের মধ্যে সামঞ্জস্য না হওয়ায় দেশের যে উন্নতির কথা বলা হচ্ছে তার কোনো ইতিবাচক ফল মানুষ পাবে না।
২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে মঙ্গলবার ‘স্টেট অফ দ্য বাংলাদেশ ইকোনমি ইন ২০১৭-১৮’ শীর্ষক আলোচনায় সিপিডির এই বক্তব্য আসে।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, “সরকারের হিসাব থেকে আমরা দেখছি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। পাশাপাশি আমরা দেখছি, দেশের সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে।
“প্রবৃদ্ধি দিয়ে তো আমাদের কিছু হবে না। প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে আমরা তর্ক-বিতর্ক করতে পারি, কিন্তু তার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, এর ফলাফলটা কী? আসল কথা হচ্ছে কর্মসংস্থান হল কি না, আয় হল কি না।”
মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি বৈষম্যও বেড়েছে বলে সিপিডির পর্যবেক্ষণ।
দেবপ্রিয় বলেন, “আমরা লক্ষ্য করছি বাংলাদেশে আঞ্চলিক বৈষম্য বাড়ছে। আয় কমেছে উত্তর বাংলায়, দক্ষিণ পূর্ব বাংলায়।”
এই অবস্থা থেকে উত্তরণে কর্মসংস্থান বাড়ানোর উপর জোর দেন তিনি।
“এতদিন আমরা উচ্চতর প্রবৃদ্ধির জন্য তাগাদা দিয়েছি। এই উচ্চতর প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ হলেও আজকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে শোভন কর্মসংস্থান। কারণ যে কর্মসংস্থানটুকু সৃষ্টি হয়েছে, সেটুকু হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। সেখানে আয় কম।
“ফলাফলটা হল, আমরা এখন আয়হীন কর্মসংস্থান পাচ্ছি। কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধির বিপরীতে।”
প্রায় এক দশক ৬ শতাংশের বৃত্তে আটকে থাকার পর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ অতিক্রম করে। এরপর গত দুই অর্থবছর ধরেই প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।
যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তাও সরকারি বিনিয়োগের কারণে বলে সিপিডির পর্যবেক্ষণ।
দেবপ্রিয় বলেন, “ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ গত তিন বছর যাবত প্রায় একই জায়গাতে স্থবির হয়ে আছে।”
তাহলে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে বেসরকারি ঋণপ্রবাহ যে বাড়ছে, সেই অর্থ কোথায় যাচ্ছে, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি।
“এই টাকা গেল কোথায়? বিনিয়োগ বাড়ল না ব্যক্তি খাতে। এই টাকা গেল কোথায়?”
“পুঁজিপণ্য আমদানি হচ্ছে এবং ব্যক্তিখাতে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের টাকাও যাচ্ছে, কিন্তু ব্যক্তি বিনিয়োগ হচ্ছে না, এটা কী রকম কথা!”
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, “আমাদের প্রবৃদ্ধি কিছুটা গতিশীল হয়েছে কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধি সত্যিকার অর্থে আয় বৃদ্ধি করতে পারছে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখন সার্বিকভাবে স্থিতিশীলতা কিছুটা ‘দুর্বল’।
“একইভাবে আমাদের রপ্তানি আয় এবং রেমিটেন্স বাড়লেও আমাদের বৈদেশিক লেনদেনে একটা চাপ তৈরি হচ্ছে। ফলে টাকার যে মূল্যমান সেখানেও একধরনের ডেপ্রিসিয়েশন হচ্ছে।”
এই পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচনের বছর বাজেট দেওয়ার ক্ষেত্রে সংযত সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দিকে নজর রাখতে সরকারকে পরামর্শ দেন দেবপ্রিয়।
সিরডাপ মিলনায়তনে এ আলোচনা অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।]
ব্যাংক খাত ‘এতিম’
ব্যাংক খাতের অব্যস্থাপনা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, “২০১৭ সাল ছিল ব্যাংকিং কেলেঙ্কারির বছর, এবার আমার মনে হয় ব্যাংকিং ব্যবস্থা এতিমে পরিণত হয়েছে।”
ব্যাংক রক্ষার দায়িত্ব যাদের, তারা এখন ‘এতিমের ওপর অত্যাচার করছেন’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, “তারল্য ঘাটতির কথা বলে সিআরআর কমানো হচ্ছে। তারল্য ঘাটতি তো হলে একটা রোগের উপসর্গ। এটা তো রোগ না। রোগ হচ্ছে আপনি একটা বিকলাঙ্গ ব্যাংকিং ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছেন।”
দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তুলতে সরকারি উদ্যোগে অর্থ দেওয়ার বিরোধিতাও করেন তিনি।
“মানুষের করের টাকা দিয়ে এইভাবে ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা এবং এখানে যে পরিমাণ দুর্নীতি হচ্ছে, এ জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়াটা ঠিক না।”
এই ধরনের ব্যাংকের জন্য অর্থের অন্য উৎস খোঁজার পরামর্শ দেন তিনি। প্রয়োজনে ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার পক্ষেও মত দেন তিনি।
দেশীয় মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতার জন্য রিজার্ভ ব্যবহারের পক্ষেও মত দেন দেবপ্রিয়।