লেনদেন ভারসাম্যে বড় ঘাটতি

আমদানির চাপে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে বড় ধরনের ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ।

আবদুর রহিম হারমাছিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 April 2018, 05:29 AM
Updated : 17 April 2018, 05:35 AM

বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যালেন্স অব পেমেন্টের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আট মাসেই (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) এই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৩১ কোটি ৮০ লাখ ডলারে।

আট মাসের এই ঘাটতি গত অর্থবছরের একই সময়ের (আট মাস) চেয়ে ৭ গুণ বেশি। আর পুরো অর্থবছরের (জুলাই-জুন) ঘাটতির চেয়ে সাড়ে ৪ গুণ বেশি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে লেনদেন ভারসাম্যে এত বড় ঘাটতি আগে কখনো হয়নি। তবে সরকারের আর্থিক হিসাবে বড় উদ্বৃত্ত থাকায় এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার মত কিছু দেখছেন না গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।

সাধারণভাবে কোনো দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝা যায় চলতি হিসাবের মাধ্যমে। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করতে ঋণ নিতে হয়।

# ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে লেনদেন ভারসাম্যে ৯৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার ঘাটতি ছিল। জুনে অর্থবছর শেষে তা ১৪৮ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।

# আর চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি  দাঁড়িয়েছে ৬৩১ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দ্বিগুণ

চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ৩ হাজার ৫৮২ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২ হাজার ৪০৮ কোটি  ৯০ লাখ ডলার।

এ হিসাবে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরে যা ৬০৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার ছিল।

পণ্য বাণিজ্যের পাশাপাশি সেবা বাণিজ্যেও ঘাটতি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে সেবা বাণিজ্যে মোট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৯৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ২১১ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

 

সেবা খাতের বাণিজ্যে মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে।

অর্থনীতির গবেষক মোস্তাফিজুর রহমান মনে করছেন, লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা অর্থবছরের বাকি সময়েও অব্যাহত থাকবে আমদানি বাড়তে থাকার কারণে। তবে আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকায় বড় কোনো ঝুঁকির আশঙ্কা নেই।

“আমদানি যেটা বাড়ছে সেটা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেলসহ বড় প্রকল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানির জন্য বাড়ছে। এ সব আমদানির বিল ফরেন এইড যেটা আসছে সেটা থেকেই পরিশোধ করা হচ্ছে।”

সে কারণে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এবং ওভারওল পেমেন্টে (সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্য) ঘাটতি দেখা দিলেও ফাইনানশিয়াল অ্যাকাউন্টে (আর্থিক হিসাবে) উদ্বৃত্ত রয়েছে বলে জানান মোস্তাফিজ।

# চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই হিসাবে ২৫ কোটি ১০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

# বিদেশি বিনিয়োগ ও বিদেশি সহায়তা ছাড়ের পরিমাণ বাড়ায় অর্থবছরের প্রথম আট মাসে আর্থিক হিসাবে বড় উদ্বৃত্ত দেখা যাচ্ছে। গত অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে যেখানে ২৯৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল, এবার তা ৫৭৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে।

# ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ২২৭ কোটি ৫০ লাখ ডলারের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) দেশে এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ২১৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

# এই সময়ে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাবদ দেশে এসেছে ৩২২ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ৮৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেশি।

নজর দিতে হবে যেদিকে

চলতি হিসাব ভারসাম্যে ঘাটতি নিয়ে এখনই বিচলিত হওয়ার মত কিছু না দেখলেও আমদানির আড়ালে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে (পণ্যের বেশি মূল্য দেখিয়ে) টাকা পাচার হচ্ছে কিনা- সে বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, “এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে, যাতে কোনো অবস্থাতেই কোনো আমদানিকারক দাম বেশি দেখিয়ে পণ্য আমদানি করতে না পারে বা এক পণ্যের নামে অন্য পণ্য বা খালি কনটেইন্টার না আসে।”

বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে রপ্তানি আয় এবং রেমিটেন্স প্রবাহ আরও বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ।

তিনি বলেন, “এবার রেমিটেন্স ১৭ শতাংশের মতো বেড়েছে। অর্থবছর শেষেও হয়তো প্রবৃদ্ধি এমনই হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, গত অর্থবছর প্রায় ১৫ শতাংশ রেমিটেন্স কম এসেছিল। ওটা যেন পূরণ হয় সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে।”