এখন জোর দিতে হবে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে: আহসান মনসুর

উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠলে সস্তা ঋণ পাওয়া এবং বিভিন্ন রপ্তানি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ; সেই পরিস্থিতি মোকাবেলায় ‘অর্থনৈতিক কূটনীতি’র দিকে এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।

জাফর আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 March 2018, 03:44 AM
Updated : 12 Jan 2021, 04:17 PM

তিনি বলেছেন, “এলডিসি পরবর্তী সময়ে প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে বিশ্ববাজারে আমাদের রপ্তানি পণ্য প্রবেশ নিয়ে। আমাদের অবশ্যই ইকোনমিক ডিপ্লোমেসির দিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে তৎপর হতে হবে।”

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠার যোগ্যতা অর্জনের পর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর।

‘ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি’র ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “এখন থেকে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উপর জোর দিতে হবে। যেসব দেশে আমাদের পণ্যের চাহিদা রয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে চুক্তি করতে হবে।”

রপ্তানি বাণিজ্যে জোর দেওয়ার পাশাপাশি দেশে অবকাঠামো উন্নয়নসহ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়াতে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শও দেন এই গবেষক।

তিন বছর আগে বিশ্ব ব্যাংকের বিচারে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পর এখন জাতিসংঘের দৃষ্টিতেও বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটেছে।

১৯৭৫ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে থাকা বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সব শর্ত পূরণ করেছে। এই যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতিপত্র সম্প্রতি তুলে দেওয়া হয়।

>> জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল (ইকোসক) এর মানদণ্ড অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, জাতিসংঘের হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ১২৭৪ ডলার।

>> ইকোসকের মানবসম্পদ সূচকে উন্নয়নশীল দেশ হতে ৬৪ পয়েন্টের প্রয়োজন; বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ৭২।

>> অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ২৫ দশমিক ২। এই পয়েন্ট ৩৬ এর বেশি হলে এলডিসিভুক্ত হয়, ৩২ এ আনার পর উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন হয়।

জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব হাওলিয়াং জু বলছেন, তিনটি শর্ত একবারে অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশই প্রথম দেশ এবং বাংলাদেশ এতটাই এগিয়ে আছে যে মূল্যায়নকাল পেরিয়ে ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশে আনুষ্ঠানিক উত্তরণের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যাই হবে না।  

আহসান মনসুরও মনে করেন, বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট কোনো দুর্যোগ না হলে তিনটি সূচকের কোনোটিতেই বাংলাদেশের আর পিছিয়ে পড়ার কোনো কারণ নেই।

ফলে ২০২৪ সালে পূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সনদ নিয়ে বাংলাদেশের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো আসবে, তা নিয়েই বলছেন তিনি।

আহসান মনসুর বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সংস্থার সস্তা ঋণ পাওয়ার সুবিধা হারানো শুরু হচ্ছে বাংলাদেশের।

“এখনই আমরা ঋণ সুবিধার আংশিক হারিয়ে ফেলছি। কারণ বিশ্ব ব্যাংকসহ দাতাসংস্থাগুলো মাথাপিছু আয়ের হিসেবে সস্তা ঋণ দেয়। এখন আমাদের যেহেতু মাথা পিছু আয় বেড়েছে, তাই এখন থেকেই তারা সস্তা ঋণ কমিয়ে দেবে। এটা আস্তে আস্তে আরও কমে যাবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক এ কর্মকর্তা বলেন, এখন থেকে ঋণদাতারা নমনীয় ঋণ কমিয়ে অনমনীয় ঋণ বাড়াবে।

“তবে আরও বেশ কয়েক বছর বিশ্ব ব্যাংক আমাদের কিছুটা বেশি সুদের ঋণের সঙ্গে আগের মতো সস্তা ঋণের সুযোগও বহাল রাখবে। তবে ক্রমান্বয়ে সস্তা ঋণ কমবে আর বেশি সুদের ঋণ বাড়বে।”

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর

সেই সঙ্গে রপ্তানি বাণিজ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা কমে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ আসার কথাও বলেন আহসান মনসুর।

“বিশ্ব বাজারে এখন আমরা এলডিসি হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, ভারত, জাপান এবং অষ্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশে যে জিএসপি ‍সুবিধা পাই, তা আমরা ক্রমান্বয়ে সেই সুবিধা হারাব। তখন আমাদের ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে।”

তাই এখন থেকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বাড়ানোর উপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, যেসব দেশে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা রয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর মাধ্যমে চুক্তি করতে হবে।

এক্ষেত্রে ভিয়েতনামকে অনুসরণ করতে বলেন আহসান মনসুর।

“এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর দেশটি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (এফটিএ) করেছে। আমাদেরও তাই করতে হবে। তারা আসিয়ানের মেম্বার হওয়া ছাড়াও অনেক পদক্ষেপ নিয়ে বাজারে প্রবেশের ব্যবস্থা করে ফেলেছে।

“সফল ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি দিয়ে দেশটি আজ কোথায় চলে গেছে। বর্তমানে ভিয়েতনামের রপ্তানি প্রায় ২৩০ বিলিয়ন ডলার। আর আমাদের মাত্র ৩৫ বিলিয়ন ডলার।”

বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার জন্য অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তুতি এখন থেকে নেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন আহসান মনসুর।

“আমরা সক্ষমতা যদি অর্জন করতে পারি, তাহলে আমাদের যে ১৪/১৫ শতাংশ কর দিতে হবে সে সক্ষমতাও অর্জন করতে পারব। আমাদের দক্ষতা দিয়ে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে এনে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

“সক্ষমতা বাড়াতে হবে চতুর্দিক থেকে। প্রথমত আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এখানেই হয়ত আমরা এক থেকে দুই শতাংশ বাঁচাতে পারি। ঢাকা থেকে একটি ট্রাক চট্টগ্রাম যেতে এখন প্রায় ১২ ঘণ্টা সময় লাগে। সেটা যদি ৪ ঘণ্টায় সম্ভব হয়, তাহলে অবশ্যই ভাড়া কমে যাবে। এটাই হচ্ছে সক্ষমতা।”

শিল্প প্রতিষ্ঠানে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের ওপরও জোর দেন আহসান মনসুর।

“মানসম্পন্ন বিদ্যুতের অভাবে আমাদের অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জেনারেটরের প্রয়োজন হয়। এ জেনারেটরের পেছনে অনেক ব্যয় হয়। প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে বিদ্যুৎ দিতে পারলে উৎপাদন খরচ আরও কিছুটা কমে আসবে।”

আরও উন্নয়ন করে বন্দরকে আরও কার্যকর করা গেলে সেটাও সক্ষমতা বাড়িয়ে তুলবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“চট্টগ্রাম পোর্টে যদি মালামাল তিন দিন বা তিন সপ্তাহ আটকে না থেকে যদি এক দিনেই চলে যায়, তাহলে অবশ্যই উৎপাদন খরচ কমে যাবে।”

.

আধুনিক মূলধনী যন্ত্রপাতি এনে শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়িয়ে যে ব্যয় আরও কমিয়ে আনা যায়, সে পথও দেখান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সাবেক এই শিক্ষক।

তিনি মনে করেন, অভ্যন্তরীণ কর্মদক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি বিনিয়োগ আকর্ষণের সক্ষমতাও তৈরি করতে হবে।

“একজন বিনিয়োগকারী ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে আগে ১০ টাকা লাভ পেতেন, সক্ষমতা বাড়িয়ে যদি ১৫ টাকা লাভ পান, তাহলে বিনিয়োগকারী আরও আগ্রহী হবেন।”

চাঁদাবাজি, পুলিশের হয়রানি, দুর্বৃত্তায়ন, রাস্তায় টোল আদায়সহ বিনিয়োগের সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করার উপর জোর দেন তিনি।

বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর উপর জোর দিয়ে আহসান মনসুর বলেন, “আমরা বছরে পাচ্ছি ২ বিলিয়ন ডলারের মতো। কিন্তু ভিয়েতনাম পাচ্ছে ১৭/১৮ বিলিয়ন ডলার। কেন পায়? এই প্রশ্ন আমাদের নিজেদের করতে হবে। বিনিয়োগকারীরা আমাদের দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। কেন যায়?

“স্যামসাং আমাদের দেশে আসছিল বিনিয়োগের জন্য। তাদের আমরা জায়গা দিলাম না। তারা ভিয়েতনামে গিয়ে বিনিয়োগ করল। এখন সেই কারখানা থেকে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি হয়। অথচ ওই কারখানাটা বাংলাদেশে হতে পারত। আমাদের একটি সার কারখানা বন্ধ করে হলেও তাদের গ্যাস দেওয়া উচিৎ ছিল।”

আহসান মনসুরের মতে, কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীর সুরক্ষার নাম করে তাদেরকে দিয়ে অদক্ষ ইন্ডাস্ট্রি করা হবে নাকি বিশ্ববাজারে টিকে থাকার জন্য দেশের সম্পদকে রপ্তানিমুখী বাজারের দিকে পরিচালিত করা হবে- সেই সিদ্ধান্ত এখন সরকারকে নিতে হবে।

তিনি বলেন, উৎপাদনের ব্যয় যখন কমে আসবে, তখনই ব্যাপক হারে বিদেশি বিনিয়োগ আসা শুরু হবে। সেজন্য পণ্য পরিবহনে সড়ক, রেল ও জলপথের উন্নয়ন, বড় বড় অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো বিনিয়োগ উপযোগী করে তুলতে হবে।

বাজার চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মানব সম্পদ তৈরিতে জোর দিয়ে আহসান মনসুর বলেন, “শুধু আইএ, বিএ পাস করিয়ে ছেড়ে দিলাম, তা হবে না। যে খাতের বেশি চাহিদা, সেই খাতে বেশি লোকবল তৈরি করতে হবে।”

বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং সুশাসনের অভাব থাকার বিষয়টি তুলে ধরে তা দূর করতেও মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

“মন্ত্রণালয়, বিচার বিভাগ, পুলিশসহ প্রত্যেকটি বিভাগই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠান এখন দেশের স্বার্থে জাতির স্বার্থে কাজ করে না। তারা কোনো একটা গোষ্ঠী বা ব্যাক্তির স্বার্থে করে। এখান থেকে আমাদের বের হতে হবে।”

তবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠাই যে শেষ কথা নয়, সেই সতর্কবার্তাও দেন আহসান মনসুর।

জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব যেভাবে বলেছেন, একই কথা বলেন তিনি। 

“পৃথিবীতে বেশিরভাগ দেশই মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে। মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশে যাওয়ার জন্য যেসব সংস্কার বা উন্নয়নের দরকার হয়, তা করতে না পারায় দেশগুলো আর উন্নত দেশ হতে পারছে না। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্সসহ আরও অনেক দেশ রয়েছে এই তালিকায়।”

বাংলাদেশ যাতে ওই ফাঁদে আটকে না পড়ে, সেজন্য ওই সব দেশের সঙ্কটের অভিজ্ঞতা জানার পরামর্শ দিয়েছেন জাতিসংঘ কর্মকর্তা হাওলিয়াং জু।

আহসান মনসুর বলেন, বাংলাদেশ যেন এই ফাঁদে না পড়ে সে জন্য প্রয়োজনীয় সকল অবকাঠামোর পাশাপাশি যথা সময়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তও সরকারকে নিতে হবে।