উন্নয়নের সঙ্গে বৈষম্যও ‘দূর করতে হবে’

অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে ধনী-গরিবের বৈষম্যও বেড়ে যাওয়ার দিকটি তুলে ধরে তা কমিয়ে আনতে মনোযোগী হওয়ার সুপারিশ এসেছে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান থেকে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2018, 06:02 AM
Updated : 25 March 2018, 10:10 AM

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটলে যে চ্যালেঞ্জগুলো সামনে আসবে, তা মোকাবেলায় এখন থেকে প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন এই গোলটেবিলের আলোচকরা।

বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় অর্থনীতিবিদ, নীতি-নির্ধারক, সাংবাদিকরা ঢাকার গুলশানের আমারি হোটেলের এই আলোচনায় অংশ নেন।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের পর তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনার প্রেক্ষাপটে ‘উন্নয়নশীল বাংলাদেশ : চ্যালেঞ্জসমূহ’ শিরোনামে এই গোলটেবিলের আয়োজন করে একাত্তর টেলিভিশন।

বিশ্ব ব্যাংক নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে তোলার পর জাতিসংঘের মাপকাঠিতেও উত্তরণ ঘটছে বাংলাদেশের; স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উঠতে যাচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে।

আলোচনায় বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “অর্থনৈতিক অগ্রগতি হচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু বৈষম্য কমছে না, বেড়েছে।”

তিনি অঞ্চলভিত্তিক কর্মসংস্থান ও শিক্ষার বৈষম্য বেড়ে চলার উদাহরণ দেন।

জামালউদ্দিন আহমেদ

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের থেকে বৈষম্য দ্বিগুণ হয়েছে।

“বঙ্গবন্ধুর সময় (১৯৭৪ সাল) জাতীয় আয়ে বৈষম্য ছিল দশমিক ২৪। বর্তমানে সেটা হয়েছে দশমিক ৪৮।”

বৈষম্য সমাজকে ভেঙে ফেলে- মন্তব্য করে ইব্রাহিম খালেদ বলেন, “ফাঁকটা হল এখানে, সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি থেকে যত টাকা পয়সা এসেছে, তা কি ১৬ কোটি লোকের কাছে না কি কিছু লোকের কাছে গেছে?

“এখন কিছু লোক বড় লোক হয়েছে, প্রবৃদ্ধি থেকে যা এসেছে, তা পাহাড়ের উপর দিয়ে গিছে, সমতল ভূমিতে পৌঁছায়নি।”

একাত্তরে মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রণয়নে যুক্ত এবং স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম সংবিধান অনুসরণে মানুষের জীবনমান ও বৈষম্য নিরসন না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, “উন্নয়ন একটা দ্বায়িত্ব নিয়ে আসে। এটা টেকসই রাখার সক্ষমতা আমাদের আছে কি না?”

উন্নয়নের প্রথম দিকে বৈষম্য বেড়ে যায় বলে মন্তব্য করেন ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। এক্ষেত্রে তিনি চীন, ভারতের উদাহরণ টানেন।

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

তবে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্যের লাগাম টেনে ধরার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন মির্জ্জা আজিজ।

দারিদ্র্য বিমোচনের হার ক্রমশ কমে যাওয়া উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “বেশি উদ্বেগের বিষয়, দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু অগ্রগতির হারটা ক্রমশ কমে আসছে।”

তাদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী বাজার অর্থনীতির মধ্যে বৈষম্যসহ নানা ধরনের ভঙ্গুরতা থাকার উদাহরণ দেখান।

তিনি বলেন, “বাজার অর্থনীতির মধ্যে অনেক রকম ভঙ্গুরতা রয়েছে। আমাদের নিজেদের অনেক ক্রিয়েটিভ হতে হবে। আমেরিকায় বৈষম্য অনেক বেশি।”

যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় শতক ধরে কীভাবে বৈষম্য বেড়েছে, তা একটি বইয়ের বরাত দিয়ে তুলে ধরেন তৌফিক ইলাহী।

প্রস্তুতি নেওয়ার সময় ‘এখনই’

যে সব মাপকাঠিতে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটেছে, গোলটেবিলে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ।

আবুল কালাম আজাদ

১৯৭৫ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক (ইভিআই) এই তিন শর্ত পূরণ করে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠতে যাচ্ছে।

আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাদেশ প্রথম দেশ হিসেবে এই তিনটি শর্ত একসঙ্গে পূরণ করে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠতে যাচ্ছে।

আগামী বছরগুলোতে পর্যবেক্ষণে থাকার পর অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম উঠবে বাংলাদেশের।

স্বল্পোন্নত দেশ হলে বিভিন্ন সংস্থার সহজ শর্তে ঋণ এবং রপ্তানি পণ্যে বিশেষ সুবিধা আর থাকবে না।

সভায় আলোচকরা বলেন, তবে বিনিয়োগ বাড়ানোসহ নানাভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সুযোগ রয়েছে।

গোলটেবিল আলোচনায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী এখন থেকেই সেই প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, “প্রবৃদ্ধিকে আমরা চাইলে দুই অঙ্কে নিতে পারতাম, কিন্তু আমরা পারিনি। কারণ আমাদের বিভিন্ন রকম সমস্যা ছিল। আমরা নিজেদের মধ্যে কলহ করতে বেশি পছন্দ করি।

“কাজেই আমরা যদি নিজেদের মধ্যে কলহ না করতাম, আমরা যদি সত্যি সত্যি কাজ করতাম, যার যা ভূমিকা তা যদি ঠিকমতো পালন করতাম, প্রবৃদ্ধির এই হার আরও বেশি হতে পারত।”

বাংলাদেশের অগ্রগতিতে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা এই স্বীকৃতির মাধ্যমে কমবে না বলে মনে করেন মির্জ্জা আজিজ। সরকারি কাজ কীভাবে ‘সমন্বয়ের মাধ্যম’ করা যায়, তার উপর গুরুত্ব দেন তিনি।

তৌফিক ইমরোজ খালিদী

বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকারি সংস্থাগুলোকে সেবামুখী করা এবং  অদক্ষতা দূর করতে সংস্কার চালানোর উপর জোর দেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

তিনি বলেন, “সেবা দেওয়ার চেয়ে তারা কর্তৃত্ব করতে বেশি পছন্দ করেন। এই অবস্থাটা বদলাতে হবে।”

ব্যারিস্টার আমীরও আমলাদের মান বাড়ানোর উপর জোর দেন। কোন ক্ষেত্রে কতটুকু উন্নয়ন হচ্ছে এবং কোথায় কতটুকু প্রয়োজন, সে বিষয়ে সরকারকে নিরীক্ষা চালানোর পরামর্শ দেন তিনি।

তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, আরেকটি বড় বিষয় যেটা, মানব সম্পদ উন্নয়ন সূচক। যেখানে পুষ্টি, স্বাস্থ্য, বয়স্কদের সাক্ষরতা, মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষার্থীদের ভর্তির হার এই যে বিষয়গুলো রয়েছে।

“অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগেন এমন মানুষের সংখ্যা কমানোকে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হয়। আপনি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমাতে পারবেন খুব সহজে, একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নিয়ে আসলেই আপনি বলতে পারেন আপনি আর দরিদ্র নন। কিন্তু মানসম্মত খাবার তিনি পান কি না, সেটা একটা ভিন্ন ও বড় চ্যালেঞ্জ।”

এছাড়া অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকও বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন এই সাংবাদিক।

“এখানে ৩২ বা তার নিচে হলে হয়, আমরা ২৬ এর নিচে আছি। মোটামুটি একটা জায়গায় আছি... এখানে আমাদের কাজ করতে হবে। দুটো বিষয় আছে বাণিজ্য সংক্রান্ত ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়... প্রাকৃতিক দূর্যোগ এখনও আমাদের দেশের বহু মানুষকে গৃহহীন করে, এই জায়গায় কী করতে পারব তা দেখবার বিষয়।”

আতিক রহমান

পরিবেশবিদ আতিক রহমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেন।

তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “প্রবৃদ্ধির কারণে আমাদের জীবন মানের উন্নয়ন হবে, বিকাশ হবে। মধ্যবিত্তের যে আকার-আকৃতি ও সংখ্যা, তা বাড়বে। তাতে আমাদের বাজারের একটা ক্ষমতা তৈরি হবে, বিনিয়োগ বেশি আসবে, এজেন্সিগুলো আমাদের ভিন্নভাবে রেটিং করবে, বিদেশি বিনিয়োগ আরও বেশি আসবে আমাদের দেশে, আমরা আরও বড় বাজার হব, বড় বাজার হলে আমাদের দেশের মানুষদের জীবনমানের উন্নয়ন হবে।”

মির্জ্জা আজিজ বলেন, জাতিসংঘের স্বীকৃতির মাধ্যমে জাতি হিসেবে আত্মবিশ্বাস বাড়লেও ভবিষ্যতে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেটা ঐকব্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করতে হবে।

“সকলে মিলে যদি প্রস্তুতি নিতে পারি তাহলে মোকাবেলা করতে পারব,” বলেন আবুল কালাম আজাদ।

‘ভাগ সবাইকে দেব না’

রাজনৈতিক একটি সরকারের ধারাবাহিকতার কারণে অর্থনৈতিক এই উন্নয়ন হয়েছে দাবি করে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক ইলাহী এজন্য শেখ হাসিনাকে কৃতিত্ব দেন।

অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ

তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী

তার আগে আলোচনার শুরুতেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর রশীদ বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়ন হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসীদের হাতে ক্ষমতা থাকলে উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর এই বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক ইলাহী বলেন, আগের ৩৭ বছরের যে অর্জন, তার চেয়ে বেশি অর্জন হয়েছে এই ১০ বছরে।

“শেখ হাসিনা ইজ অ্যা ভেরি আনইউজুয়াল লিডার। একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, একজন সাহসী ও প্র্যাকটিক্যাল মানুষ। ক্রিকেট টিম যেভাবে একটি টিম হিসেবে খেলে জিতে, দেশটাকেও এগিয়ে নিতে একটি টিম লাগে।”

আলোচনায় জাতিসংঘের এই স্বীকৃতিকে দেশের মানুষের অর্জন বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য উদ্ধৃত করেন।

তৌফিক ইলাহী বলেন, “আমাদের যে অর্জন হয়েছে, তা অবশ্যই মানুষের অর্জন। কিন্তু আপনারা সবাই এটা ভাগাভাগি করে নিতে পারবেন না। এর ভাগ সবাইকে দেব না।”

তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “তিন সূচকে যে পরিবর্তন ঘটছে, যার মধ্যে দুই-একটিতে পরিবর্তন গত ১২-১৩ বছরে বেশি ঘটেছে। সুতরাং গত ৯-১০ বছর যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা বেশি কাজ করেছেন, সেই দাবি করতেই পারেন, দাবির যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে।”

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল (ইকোসক) এর মানদণ্ড অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার। জাতিসংঘের হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ১২৭৪ ডলার।

মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে উন্নয়নশীল দেশ হতে ৬৪ পয়েন্টের প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশের পয়েন্ট তা ছাড়িয়ে এখন ৭২।

অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ২৫ দশমিক ২। এই পয়েন্ট ৩৬ এর বেশি হলে এলডিসিভুক্ত হয়, ৩২ এ আনার পর উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন হয়।

মোজাম্মেল বাবু

আমীর-উল ইসলাম

চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা করে ব্যারিস্টার আমীর বলেন, “মুক্তিযোদ্ধারা কি কোটার জন্য দেশ স্বাধীন করেছিল? কোটা চালু করে চাকরির জন্য একটা বেচা-কেনার জায়গা করা হয়েছে।”

এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “কোটা ব্যবস্থার সংস্কার হতে পারে। তবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটার প্রয়োজন রয়েছে।”

রিয়াজ উদ্দীন আহমেদ

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবুর সঞ্চালনায় এই গোলটেবিলে আলোচনা করেন নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজ উদ্দীন আহমেদ, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।