বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে: গওহর রিজভী

প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেছেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হতে চললেও দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে, যা নিয়ে উদাসীন থাকলে চলবে না।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 March 2018, 03:23 PM
Updated : 10 March 2018, 04:12 PM

দুর্নীতিপ্রবণ দেশ দারিদ্র্য বিমোচনে সফলতা অর্জন করতে পারে না বলেও সতর্ক করেছেন তিনি।

শনিবার বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ এবং অপ্রদর্শিত ঝুঁকি ও প্রতিশ্রুতি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা।

অক্সফোর্ড, হার্ভার্ডসহ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে আসা গওহর রিজভী বলেন, “স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে আমরা বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলেও বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে এখনও বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। বৈষম্যের বিষয়ে আমাদের উদাসীন হলে চলবে না।”

তিনি বলেন, “আমরা দারিদ্র্য বিমোচনে অনেক চেষ্টা করছি। এটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু আমরা এখনও দারিদ্র্য শেষ করতে পারিনি।

“এক্ষেত্রে সুশাসনের বিষয়টি জড়িত। সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারলে দারিদ্র্য বিমোচনেও সফলতা পাওয়া যায় না- এটা পরিসংখ্যানে প্রমাণিত। যেসব দেশ দুর্নীতির সাথে জড়িত সে দেশ দারিদ্র্য বিমোচনে সফলতা পায় না। সুতরাং আমাদের এসব বিষয়ে অবশ্যই মনোযোগী হয়ে কাজ করতে হবে।”

অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতির জন্য গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে সিপিডি চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, “স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে যাচ্ছে, এটা সাম্প্রতিক উন্নয়ন ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অনন্য ঘটনা।”

বাংলাদেশের এ সফলতাকে নেপাল, মালদ্বীপ বা অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করতে রাজি নন তিনি। কারণ ব্যাখ্যায় অর্থনীতির এই অধ্যাপক বলেন, “নেপাল বা মালদ্বীপের সঙ্গে তুলনা দিয়ে বাংলাদেশের সফলতা বোঝা যাবে না। কম জনসংখ্যার সে দেশগুলোতে জ্বালানির ওপর কিছু বড় ধরনের বিনিয়োগ দিয়েই সার্বিক উন্নয়ন রেখা পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো বিশাল অর্থনীতির দেশের সঙ্গে তাদের তুলনা হয় না।”

তিনি বলেন, “এদেশের সরকার, কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষসহ সার্বিকভাবে সকল মানুষের নিজ নিজ অবস্থান থেকে উন্নয়ন প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে যাচ্ছে।

“আমাদের এনজিওগুলো মানব উন্নয়নের পাশাপাশি সরকারের সাথে যৌথভাবে স্বাস্থ্য সেবা ও পুষ্টি সরবরাহে ভূমিকা রেখেছে।”

উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে যাওয়ার পর অর্থনীতিতে যেসব চ্যালেঞ্জ আসবে সেগুলো মোকাবেলার প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে রেহমান সোবহান বলেন, “আমরা উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর ২০২৪ সালের পর থেকে আমরা সস্তা ঋণ পাব না। ফলে বেশি সুদে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা নিয়ে এমন একটি কৌশল নিতে হবে যাতে আমাদের বৈদেশিক ঋণের প্রবাহ অবাধ থাকে। একইসঙ্গে দেশীয় সম্পদের যোগান আরও বাড়াতে হবে।”

বঙ্গবন্ধু সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের এ সদস্য মনে করেন, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর বাংলাদেশকে সামাজিক ও মানসিক দু্ভাবেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

কৃষকের জন্য শিল্পে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য দ্বিপক্ষীয় দর কষাকষির সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিশ্ব রপ্তানি বাজারে নিজের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে হবে।

ইউরোপের বাজারে মৎস্য রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন রেহমান সোবহান। পাশাপাশি এসএমই শিল্প থেকে রপ্তানিবান্ধব বৈচিত্র্যপূর্ণ উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলেন তিনি।

বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারে এমন দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেন এই অর্থনীতিবিদ।

তিনি বলেন, “উন্নয়নশীল বিশ্বে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ আসার পথ তৈরি হবে। এ সময় তাদের সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে বৈদেশিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ কৌশল গ্রহণ করতে হবে।”

তবে সব কিছুর আগে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার মন্তব্য করেন রেহমান সোবহান বলেন, “দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করার পাশাপাশি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বাজায় রাখা আমাদের উন্নয়নের অন্যতম মৌলিক দাবি।”  

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “যে সমস্ত দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়েছে তাদের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, প্রায় সব দেশের উত্তরণের পরে প্রবৃদ্ধির হার ও বৈদেশিক সাহায্যের পতন ঘটে। আবার অনেক ক্ষেত্রে তাদের রেমিটেন্সের পতন ঘটে। এর ফলে তাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনার ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে কর আদায়ের পরিমাণ না বাড়াতে পারলে।

“তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, দেশগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিনিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে সফল হবে কি না তা দেখার বিষয়।”

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “উন্নয়নশীল দেশের কাতারে বাংলাদেশের মান সম্পন্ন উপায়ে যাওয়া উচিত। এর জন্য বাংলাদেশ বেশ সময়ও পাচ্ছে। অন্তত আগামী ২০২৭ সালের আগে বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে না।”

এর মধ্যে টেকসই উন্নয়ন ও দুটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া যাবে বলে মনে করেন তিনি।

ইউএনডিপির আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপ্পো বলেন, “এলডিসি থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে গিয়ে যুক্ত হতে বাংলাদেশ অবশ্যই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পাবে।

“কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যেতে একইসঙ্গে এসডিজি বাস্তবায়ন আবার আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপকভাবে প্রবেশে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তৈরি- দুটোই একসাথে করতে হবে।”

তিনি বলেন, “এলডিসি থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে গেলেই অনুদান কমে যাবে, ঋণ বাড়বে।তাই সার্বিকভাবে একটি রূপরেখা তৈরি করতে হবে।”

তার মতে, বেসরকারি খাতের জন্য ব্যবসা উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে হবে।

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত চারলোটা স্কালাইটার বক্তব্য দেন।