সরবরাহ সঙ্কট থেকে মূল্যস্ফীতি হলে রোখা দায়: রঙ্গরাজন

ভারতের সাবেক গভর্নর ড. চক্রবর্তী রঙ্গরাজন বলেছেন, অতিরিক্ত চাহিদা থেকে যখন মূল্যস্ফীতি হয় তা নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা থাকে। কিন্তু যখন সরবরাহ সঙ্কট থেকে মূল্যস্ফীতির সৃষ্টি হয়, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতার ক্ষেত্রে সংশয়ের সৃষ্টি হয়।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Jan 2018, 07:13 PM
Updated : 21 Jan 2018, 07:13 PM

ভারত ও বাংলাদেশের মতো দেশে কৃষি উৎপাদন অনেকটা প্রকৃতির খামখেয়ালির উপর নির্ভরশীল বলে সরবরাহ সঙ্কটের অভিজ্ঞতায় অহরহ পড়ার কথা বলেন তিনি।

রঙ্গরাজন বলেন, “যখন খাদ্য মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়, তখন  মুদ্রা নীতি ও রাজস্ব নীতি যৌথভাবে ভূমিকা রাখতে হয়। যখন খাদ্য মূল্যস্ফীতি দীর্ঘ হয় এবং এটা যখন মূল্যস্ফীতির গ্রহণযোগ্য মাত্রা অতিক্রম করে তখন মুদ্রা নীতিকে এমনভাবে পরিচালনা করতে হবে, যাতে সম্পদের রিটার্ন প্রকৃত পক্ষে ধনাত্মক হয়।”

রোববার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত ‘এ কে এন আহমেদ মেমোরিয়াল লেকচার অন সেন্ট্রাল ব্যাংকিং’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় একথা বলেন ভারতের সাবেক গভর্নর।

রঙ্গরাজন বলেন, সফল কেন্দ্রীয় ব্যাংক খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে কৌশল ও বুদ্ধি দিয়ে যে কোনো আর্থিক সমস্যার সাড়া দেয়।

অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখনকার মুদ্রা ব্যবস্থা এবং আর্থিক ব্যবস্থা অনেক বেশি জটিল হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি।

ভারতীয় মুদ্রা নীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করে ড. রঙ্গরাজন বলেন, স্বাধীনতার পর প্রথম তিন দশকে সরকারের প্রধান কাজ ছিল পরিকল্পনাসমূহের  যথাযথ বাস্তবায়ন। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক অবকাঠামো উন্নয়নে এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

আশির দশকে এসে ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং রাজস্ব ঘাটতি পূরণে ‘স্বয়ংক্রিয় মানিটাইজেশন’ নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব দেখা যায় বলে উল্লেখ করেন তিনি।

“এর পরের বছরগুলোতে রাষ্ট্রীয়  অনেক কমিটির মতামত কম বা বেশি বাস্তবায়িত হলেও ২০১৬ সালে এসে ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নমনীয় মূল্যস্ফীতি নির্ধারণের নীতির উপর ভিত্তি করে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে।

“কিন্ত এক্ষেত্রে সুদহার কখন বাড়ানো হবে আবার কখন কমানো হবে, তা নিয়ে সবসময়ই একটা বিতর্ক রয়েছে।”

তার মতে, মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত যদিও মূল্য স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যেই সমন্বয় সাধন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার কার্যক্রম পরিচালনা করে। তবে বর্তমানে মুদ্রা বিনিময় হার এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাটাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

উন্নত বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সাধারণত মুদ্রা বিনিময়ের হার বাজারের উপর ছেড়ে দেয়। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। যেমন উন্নত বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকসমূহ মুদ্রা বিনিময় হারকে স্থিতিশীল করার জন্য কখনও এককভাবে, আবার কখনও সম্মিলিতভাবে বাজারে হস্তক্ষেপ করে।

রঙ্গরাজন বলেন, ২০০৮ সালের আর্থিক সঙ্কটের আগ পর্যন্ত আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং মুদ্রানীতির সম্পর্কটি খুব একটা পরিষ্কারভাবে অনুভূত হয়নি। উন্নয়নশীল দেশসমূহের ক্ষেত্রে বর্তমানে মূল্য স্থিতিশীলতা অর্জন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান লক্ষ্য হলেও বিশ্বায়নের ফলে মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ভারতের সাবেক গভর্নর বলেন, প্রায় সমস্ত দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। তবে অধিকাংশ সরকারই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামতকে গুরুত্ব দেয়।

তিনি বলেন, মুদ্রা নীতি ও রাজস্ব নীতি যদি একমুখী না হয় তখন তা অর্থনীতির জন্য এটা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই একটা অর্থনীতিকে সুচারুরূপে কার্যকরী রাখার জন্য সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে গভীর সংলাপ ও সমন্বয় থাকা প্রয়োজন।

“১৯৩০ সালের মহামন্দার সময় তারল্য ফাঁদের কারণে মুদ্রানীতির প্রভাব ছিল না বললেই চলে। ২০০৮ সালে আর্থিক সঙ্কটের পর উন্নত বিশ্বে সুদহার শূণ্যের কোটায় পৌঁছায় এবং এর ফলে মুদ্রানীতি আবার অর্থনীতিকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে দুর্বল বলে প্রতীয়মান হয়। সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধির কারণে যখন মূল্যস্ফীতি বাড়ে, তখনই মুদ্রানীতির প্রভাব সবচেয়ে বেশী কার্যকরী হয়। মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ এ অবস্থায় সবচেয়ে ভাল কাজ করে।”

রঙ্গরাজন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তার লক্ষ্যের বিষয়ে আরও সচ্ছ ও বহির্মুখী হওয়ার পরামর্শ দেন।

“তবে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে প্রচলিত নিয়ম ও বিচারিক বিচক্ষণতার একটা সুন্দর সমন্বয়। মূল্যস্ফীতির টার্গেটিং এক্ষেত্রে সহায়ক হবে। সাধারণ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্য স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারলে এর অন্য লক্ষ্য মধ্যমেয়াদে অর্জিত হবে।”

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ও বিআইবিএম মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরীও বক্তব্য দেন।