২০১৭: গ্যাস-বিদ্যুতে দাম বৃদ্ধিতে অসন্তোষ

বিদয়ী বছরে গ্যাস-বিদ্যুৎ উৎপাদনে কিছু সাফল্যের দেখা মিললেও এগুলোর দাম বৃদ্ধিতে গ্রাহকদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল বছরজুড়ে।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2017, 05:33 PM
Updated : 30 Dec 2017, 12:41 PM

বিশ্ব বাজারে পেট্রোল-ডিজেলের দাম কমার পর দেশে মূল্য সমন্বয়ের যে দাবি ভোক্তাদের তরফে ছিল, সেটা তো পূরণই হয়নি; উল্টো বছরের শুরুতেই গ্যাসের দাম সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণায় ভোক্তা মহলে তৈরি হয় উদ্বেগ।

শেষ পর্যন্ত আদালতের আদেশে গ্যাসের বর্ধিত দামের একাংশ দেওয়া থেকে রেহাই পেলেও বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ ঝরেছে গ্রাহকদের কণ্ঠে।

এরপর বছরের শেষ ভাগে এসে বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবে সায় দিয়ে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নয় বছরে এ নিয়ে আটবার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম।

এবার দুই দফা বন্যায় ফসলহানিতে চালসহ বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুতের এই দাম বৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান নিম্নআয়ের মানুষ। এই দাম বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক বলছে ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলো। এর প্রতিবাদে হরতাল করেছে বামপন্থি দলগুলো। 

গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে বাম দলগুলো

বিভিন্ন পক্ষের বিরোধিতা উপেক্ষা করেই বছরের শুরুতে (২৩ ফেব্রুয়ারি) গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ঘোষণা অনুযায়ী প্রথম ধাপে মার্চ থেকে আবাসিকে এক চুলার জন্য মাসে ৬০০ টাকার পরিবর্তে ৭৫০ টাকা, দ্বিতীয় ধাপে জুনে ৭৫০ টাকার পরিবর্তে ৯০০ টাকা করা হয়। দুই চুলার দাম একইভাবে প্রথম ধাপে ৬৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ এবং দ্বিতীয় ধাপে ৮০০ থেকে বাড়িয়ে ৯৫০ টাকা করা হয়।

একই তালে বাড়ানো হয়, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সার কারখানা, চা বাগান ও বাণিজ্যিক গ্যাস সংযোগের বিলও। তবে গত ৩০ জুলাই গৃহস্থালিতে এক বছরে দুইবার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্ট। ফলে দ্বিতীয় দফায় জুনে যে দাম বৃদ্ধি হয়েছিল তা রহিত হয়ে যায়।

গ্যাস নিয়ে নানা সঙ্কটের খবরের মধ্যেই এপ্রিলে চীনের কনসোর্টিয়াম হিমালয় এনার্জি কোম্পানি লিমিটেডের হাতে দুই বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশ ছাড়ার ঘোষণা দেয় গ্যাস উত্তোলনকারী যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি শেভরন। এতে একদিকে শেভরন কর্মীদের মধ্যে চাকরি হারানোর শঙ্কা দেখা দেয়, অন্যদিকে পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে শুরু হয় নানা জটিলতা।

তবে বছরের শেষ দিকে এসে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে শেভরন। সিলেটের তিনটি গ্যাসক্ষেত্রে আরও কমপ্রেসার মেশিন বসিয়ে উৎপাদন বাড়াতে সরকারের সঙ্গে নতুন চুক্তিতে যায় তারা।

পেট্রোবাংলার সঙ্গে উৎপাদন-বণ্টন চুক্তির আওতায় তিনটি ব্লক (বিবিয়ানা, মৌলভীবাজার ও জালালাবাদ) থেকে গ্যাস উত্তোলন করে আসছে শেভরন। এই তিন ক্ষেত্র থেকে প্রতিদিন গড়ে ৭২ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়, যা বাংলাদেশের প্রতিদিনের গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৫৫ শতাংশ।

এদিকে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ভোলার শাহবাজপুরের পাশে নতুন একটি গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পায় বাপেক্স, যেখানে ৭০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদের আশা করা হচ্ছে। নভেম্বরের প্রথম দিনই ‘শাহবাজপুর ইস্ট-১’ নামের ওই ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়।

২০ এপ্রিল নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সুন্দলপুর-শাহাজাদপুর গ্যাসক্ষেত্রের একটি কূপ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে গ্যাস উত্তোলন শুরু করে বাপেক্স। ২০০৪ সালের অক্টোবরে সেখানে কূপ খনন প্রকল্প শুরু হয়েছিল।

বাড়ল বিদ্যুতের দাম

২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের মূল্যহার বাড়ানোর পর এবছরের ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর আবারও বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ে টানা গণশুনানি হয়।

ফলাফল- ২৩ নভেম্বর পাইকারি মূল্য না বাড়ালেও খুচরায় প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টায় ৩৫ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়, যা ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়।

এ বছর বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয়ের শুনানি থেকে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগের দেখাও মিলেছে। কেবল দাম বাড়ানোর জন্য কমিশন ‘নামমাত্র’ গণশুনানি করে সরকারের আদেশ বাস্তাবায়ন ঘটায় বলে ভোক্তা প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের অভিযোগ থাকলেও এবার কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল শুনানির ফলাফল।

পাইকারিতে প্রতি ইউনিটে ৭২ পয়সা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পিডিবি দিলেও ভোক্তাদের বিরোধিতার মুখে তা পূরণ করেনি কমিশন। তবে শুনানিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দাবিই কমিশন পূরণ করেনি বলে জানিয়েছেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল ইসলাম। শুধু লাইফলাইন গ্রাহকদের ন্যূনতম বিল বাতিলের প্রস্তাবটি মানা হয়েছে বলে জানান তিনি।

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিয়ে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে গণশুনানি

বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম বলছেন, এ বছর শুনানির ফলাফল ও প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে লাইফ লাইন বা শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী ৩০ লাখ গ্রাহকের (মোট গ্রাহকের ১৩ শতাংশ) ন্যূনতম চার্জ প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে তাদের বিদ্যুৎ বাবদ খরচ কমবে। পল্লী বিদ্যুতের ৬০ লাখ গ্রাহকের (মোট গ্রাহকের ২৫ শতাংশ) খুচরা বিদ্যুতের মূল্যহার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ সারা দেশে মোট গ্রাহকের ৩৮ শতাংশ এবারের দাম বৃদ্ধির আওতায় পড়বে না, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমবে।

বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক আখ্যায়িত করে ক্যাবের উপদেষ্টা শামসুল আলাম বলেন,  বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নীতি নির্ধারকদের খামখেয়ালিতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

“বিদ্যুতে প্রাইভেট সেক্টর-পাবলিক সেক্টরের দরপতন সমন্বয় চেয়েছিলাম সেটা হয়নি। সরকারি খাতে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালু রেখে কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে বলেছি, সেটাও মানা হয়নি। বিশেষ বিধানের আওতায় দরপত্র ছাড়াই পাওয়ার প্লান্ট, বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ, সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে ব্যয় বৃদ্ধি হচ্ছে, স্বচ্ছতা নিশ্চিত হচ্ছে না। এসব ব্যয় বৃদ্ধি অযৌক্তিক ও অন্যায়।”

এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, “কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টমুক্ত করার জন্য বিদ্যুতের সঞ্চালন, উৎপাদন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোতে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের না দিয়ে স্বার্থ সংঘাতমুক্ত ব্যক্তিদের কোম্পানির পরিচালনা বোর্ডে দিতে বলেছিলাম, সেটাও করা হয়নি। আমরা চেয়েছিলাম ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন এসব বিক্রি করে সরকার যাতে কোনো মুনাফা না করে, মুনাফা হলে তা যেন বিদ্যুতের দাম কমানোর কাজে ব্যয় করা হয়। সেটা হয়নি।”

জনবল ব্যয় বৃদ্ধিও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেন এই ভোক্তা প্রতিনিধি।

“জনবল ব্যয় বাড়িয়েছে আরইবি। যেখানে প্রতি ইউনিটে জনবল ব্যয় ৪০ পয়সা হওয়ার কথা ছিল সেখানে ৯০ পয়সা পর্যন্ত খরচ করা হয়েছে। অবচয় ব্যয় (সম্পদ অর্জন করতে যে ব্যয় হয়) ২০ পয়সার বেশি হওয়ার কথা নয়, তারা ৬২ পয়সা পর্যন্ত খরচ করেছে।”

বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয়ের খতিয়ান

দাম বৃদ্ধি নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও এই বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়েছে বাংলাদেশ।

বিইআরসি জানায়, ২০১৫ সালের অক্টোবরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ১১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। সেখান থেকে বেড়ে এখন ১৩ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে অর্থাৎ উৎপাদন দুই হাজার ২৫৪ মেগাওয়াট বেড়েছে। একই সময়ে সঞ্চালন লাইন বেড়েছে ৭৪১ সেফটিক কিলোমিটার। বিতরণ লাইন বেড়েছে ৯০ হাজার কিলোমিটার। গ্রাহক বেড়েছে ৯২ লাখ। গত এক বছরে গ্রাহক সংখ্যা ৬ শতাংশ বেড়েছে, ফলে বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ৬২ কিলোওয়াট ঘণ্টা বেড়ে এখন ৪৩৩ কিলোওয়াট ঘণ্টায় উন্নীত হয়েছে। সিস্টেম লস কমেছে এক দশমিক ৩৬ শতাংশ।

পিডিবির জনসংযোগ শাখার মহাব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ২০১৭ সালে গড়ে প্রতিদিন ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। সারা দেশে ৪৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন আছে, সম্মিলতিভাবে যেগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ১৩ হাজার ৭৭১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে নির্মাণাধীন বেসরকারি বিদুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ৬৪০০ মেগাওয়াট।

ঘোড়াশালে ৩৬৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নতুন বছরের জানুয়ারিতেই উৎপাদনে আসবে বলে পিডিবির তথ্য। সিরাজগঞ্জে ২২০ মেগাওয়াটের গ্যাস/ডিজেলভিত্তিক আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র একই সময়ে উৎপাদনে আসবে। অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রের অগ্রগতি ৭০ শতাংশের উপরে সম্পন্ন হয়েছে।

জ্বালানি তেলে আবারও ভর্তুকি

বিশ্ব বাজারে দাম কমার পর সর্বশেষ পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল-কেরোসিনের দাম কমানো হয়েছিল ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল। তবে দাম কমানোর পরও সরকারি সংস্থার বিতরণের অধীনে থাকা এই পণ্যগুলো বেশি লাভেই বিক্রি হচ্ছিল।

ক্যাবের হিসাবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সরকারি সংস্থা বিপিসি জ্বালানি তেল বিক্রি থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছিল।

তবে বিপিসির ডিরেক্টর অপারেশন অ্যান্ড প্ল্যানিং সাইয়েদ মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক বলছেন, বিশ্ব বাজারে দাম বাড়ার কারণে ইতোমধ্যেই ফার্নেস অয়েল ও কেরোসিনে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।

বিশ্ব বাজারে ডিজেলের দাম কমে প্রতি ব্যারেল ২৯ ডলারে নামার পর গত জুলাই থেকে তা বাড়তে থাকে। সর্বশেষ গত ১১ ডিসেম্বরের আমদানি তথ্য অনুযায়ী ডিজেল এখন প্রতি ব্যারেল ৭০ ডলারের বেশি।

মোজাম্মেল হক বলেন, “বিশ্ব বাজারে দাম বাড়ার কারণে জ্বালানি খাতে আগের মতো লাভ হচ্ছে না। ইতোমধ্যেই প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েলে পাঁচ এবং ডিজেলে দুই টাকা করে লোকসান শুরু হয়েছে।”

তবে বিপিসির এই হিসাবের সঙ্গে মোটেও একমত নন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা।

অধ্যাপক শামসুল বলেন, “তাদের কোনো হিসাবে কারও আস্থা নেই। তাদের হিসাব নিয়ে, অডিট নিয়ে দাতা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবির আপত্তি রয়েছে, আমাদেরও আপত্তি রয়েছে। আমরা থার্ড পার্টি দিয়ে অডিট করানোর দাবি তুলেছিলাম। সেটা কখনও করা হয়নি।

“তাদের হিসাব ধরে লাভে আছে না কি লসে আছে আমরা সেটা বিবেচনায় নিতে চাই না। সুতরাং পাঁচ টাকা ভর্তুকি আসলো নাকি কত টাকা ভর্তুকি আসলো সেটা জানার আগে স্বচ্ছ অডিট হওয়া প্রয়োজন।”