২০১৭: অর্থনীতির সাফল্য ম্লান চালের বাজারে

অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে উন্নতির ধারা বজায় থাকলেও লাগামহীন চালের বাজার আর ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খলার কারণে বিদায়ী বছরে রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশের পুরো সুযোগ নিতে পারেনি বাংলাদেশের অর্থনীতি।

আবদুর রহিম হারমাছিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Dec 2017, 04:45 AM
Updated : 28 Dec 2017, 04:45 AM

৪৬ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠেছে; রাজস্ব আদায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধিতেই রয়েছে দেশের অর্থনীতি।

তবে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল আগাম বন্যায় প্লাবিত হওয়ায় ফসলের ক্ষতির কারণে খাদ্য ঘাটতি মেটাতে আমদানি ব্যাপক বেড়ে যাওয়া, প্রধান খাদ্যপণ্য চালের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি ও ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের সঙ্কটে বড় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

ভোটের বছরে রাজনীতিতে ফের অস্থিরতা দেখা দেয় কি না; আবারও হরতাল-অবরোধ জ্বালাও-পোড়াওয়ের কবলে পড়তে হয় কি না- সে শঙ্কা নিয়েই ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার বিবেচনায় মোটা দাগে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো। টানা দুই বছর ৭ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়সহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সূচকে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলা, নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে চলা, সামাজিক রূপান্তরের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে। বিদুৎ উৎপাদন বেড়েছে; গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতেও অনেক কাজ হয়েছে।

“এ সবই আমাদের আশান্বিত করেছে। তাই বলা যায়, ২০১৭ ভালোই গেল…। ২০১৮ সালে আরও দ্বিগুণ গতিতে অগ্রসর হব।”

আর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “সার্বিকভাবে ভালোই গেছে ২০১৭ সাল। তবে চালের বাড়তি দাম গরিব মানুষসহ মধ্যবিত্তকেও বেশ দুর্ভোগে ফেলেছে। এক্ষেত্রে সরকারের ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা ছিল।”

 

নতুন উচ্চতায় প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভ, রাজস্ব আয়

মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দিয়েই মূলত দীর্ঘমেয়াদে কোনো দেশের অর্থনীতিকে পরিমাপ করা হয়। দেশের উন্নতি বা উন্নতি বা অবনতি এই সূচক দিয়েই নিরূপণ করা হয়ে থাকে।

গত ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশ পরিসখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রবৃদ্ধির চূড়ান্ত যে হিসাব প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। দেশের অর্থনীতির ইতিহাসে এই প্রথম এত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হল, যা ছিল নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩-৭৪ থেকে ১৯৭৯-৮০ সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র গড়ে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। পরের ১০ বছর জিডিপি বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ হারে। এরপর থেকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছাড়িয়ে গেছে ৬ শতাংশ।

জিডিপির আকার ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়াতে স্বাধীনতার পর ৩৪ বছর লেগেছে, যা এখন ২৪ হাজার ৯৬৮ কোটি ডলার। উন্নতি হয়েছে মাথাপিছু আয়েও; ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৬৭১ টাকা, যা এখন একলাখ ২৮ হাজার ৮০০ টাকা বা ১ হাজার ৬১০ ডলার।

তবে ফরাসউদ্দিনের মতে, এই প্রবৃদ্ধির সুফল সব মানুষ সমানভাবে পাচ্ছে না। সমাজে বৈষম্য বেড়েছে। এ সব বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার জুন মাসে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে তিন হাজার ৩০০ কোটি (৩৩ বিলিয়ন) ডলার ছাড়ায়।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর। ওই অংক ছিল আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৯ শতাংশ বেশি।

চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে এগোনোর পথে প্রথম পাঁচ মাসে ১৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির কথা সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান আশা করছেন, রাজস্ব আদায়ে এবার লক্ষ্য পূরণ হবে।

ফারমার্স ব্যাংকের শাখা এখন ৫৪টি

 

বিশৃঙ্খল ব্যাংক খাত

২০১৬ সালের শুরুতে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনা সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে। ফিলিপিন্স কর্তৃপক্ষের তৎপরতায় দেড় কোটি ডলার বাংলাদেশ ফেরত পেলেও বাকি টাকার কোনো আশা বিদায়ী বছরেও দেখা যায়নি।

এর মধ্যে ব্যাংকিং খাতে বিশৃংখল অবস্থা ছিল বছরজুড়ে। বিশেষভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেওয়া ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ সরকারের অনেক অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে।

দেশে সরকারি-বেসরকারি-বিদেশি মিলিয়ে মোট ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে আর্থিক অবস্থার অবনতির তালিকায় রয়েছে ১৩টি। বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংক ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ধুকছে; বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের অবস্থাও খারাপের দিকে।

সম্প্রতি ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ঢেলে সাজানো হয়েছে। সরানো হয়েছে দুই ব্যাংকের এমডিকেই। শুধু বেসিক ব্যাংক নয়, সরকারের অন্য বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর অবস্থাও বেশ খারাপ।

ব্যবসার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেওয়া, পর্যবেক্ষক বসানো, পর্ষদ সভার যাবতীয় নথি বিশ্লেষণ, বড় ঋণ অনুমোদন, একক গ্রাহকের ঋণসীমা নির্ধারণ ও ঋণ পুনর্গঠন ব্যবস্থা চালুসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েও ব্যাংক খাতকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে যুক্ত হয়েছে ‘পরিবর্তন আতঙ্ক’। চট্টগ্রামভিত্তিক একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে কয়েকটি ব্যাংক।

সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের উপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ব্যবস্থা আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে সংসদীয় কমিটিরও পর্যবেক্ষণ এসেছে।

বেসরকারি খাতের একাধিক ব্যাংকের মালিকানা বদল নিয়ে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটলেও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংক খাতের আমানতকারীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে।

দুই বছর ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৩ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েও পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারেনি। সার্বিকভাবে এর প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগের উপর। ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা বিনিয়োগ হচ্ছে না।

দেশে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণে যে দুর্বলতা আছে, সেকথা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বছরের শেষে এসে এক অনুষ্ঠানে স্বীকার করে নিয়েছেন। 

ফরাসউদ্দিন বলেন, “বেশ কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা খুবই খারাপ। এগুলোকে আর এভাবে চলতে দেওয়া ঠিক না। এখন ব্যাংক একীভূত (মার্জার) করার সময় এসেছে। সারা পৃথিবীতেই এটা হয়। আমাদেরও করতে হবে।”

ফাইল ছবি

 

খেলাপি ঋণ বাড়ছেই

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, নিয়মনীতি না মেনে ঋণ দেওয়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে আর্থিক খাতে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নয় বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ সাড়ে তিন গুণ বেড়ে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা হয়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে ৭ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ ঋণই এখন খেলাপি।

এছাড়া হিসারে বাইরে আরও ৪৫ হাজার কোটি টাকার খারাপ ঋণ অবলোপন ধরলে সব মিলে খেলাপি ঋণ হবে একলাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।

জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৩৪ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৮ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের দেশীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৩৩ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা, যা গত জুনে ছিল ৩১ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা।

অর্থনীতির বিশ্লেষক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “শঙ্কা হচ্ছে ব্যাংক খাত নিয়ে। ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ মুদ্রানীতির লক্ষ্য ছাড়িয়ে ১৯ শতাংশে পৌঁছেছে। ব্যাংকগুলোতে ঋণ বাড়ছে; তবে আমানত বাড়ছে না। বিশাল অংকের খেলাপি ঋণ তো আছেই।

“নতুন ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। সবগুলোই পতনের দিকে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতের দুরাবস্থা অর্থনীতির অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। ২০১৮ সালে এ দিকেই সবচেয়ে বেশি সতর্ক এবং নজর দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।”

অন্যদিকে প্রচুর অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে বলে যে অভিযোগ রয়েছে তাতেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে বলেন এই অর্থনীতিবিদ।

 

মূল্যস্ফীতি উর্ধ্বমুখী

২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে সরকার।

বেশ কিছুদিন মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও কিন্তু বিদায়ী বছরের শেষ দিকে এসে তা বেড়ে ৬ শতাংশ অতিক্রম করেছে।

সর্বশেষ অক্টোবরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। আর ১২ মাসের গড় হিসেবে এই হার ছিল ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, “সরকারি মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরও চাল আমদানি করতে দেরি করেছে সরকার; শুল্ক কমাতেও দেরি করেছে। সে কারণে চালের দাম যতোটা বাড়ার কথা ছিল তার চেয়ে বেশি বেড়েছে। যেটা এখনও অব্যাহত আছে।”

বছরের শুরুতে মোটা চালের কেজি ছিল ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা। সেই চালের দর বাড়তে বাড়তে এখন ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় উঠেছে। সরু চাল (মিনিকেট-নাজিরশাইল) ৪০/৪২ টাকা থেকে বেড়ে এখন খুচরা বাজারে ৬০ থেকে ৬৮ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

এপ্রিলে হাওড়ে বন্যায় ফসলের ক্ষতির পর থেকে বাড়তে শুরু করে চালের দাম। সে সময় সরকারের গুদামগুলোতে চালের মজুদ ২ লাখ টনেরও নীচে নেমে আসে। সে সুযোগে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে চালের তাম বাড়িয়ে দেয়।

এরপর সারা দেশে বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হলে আরেক দফা বাড়ে চালের দাম। দুই দফায় শুল্ক কমিয়েও চালের মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে পারেনি সরকার।

বৈদেশিক বাণিজ্য ও চলতি হিসাবে ঘাটতি

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের কম দামের কারণে গত দুই বছর সামগ্রিক আমদানিতে ধীরগতি দেখা গেলেও ২০১৭ সালের পুরো সময় ধরেই আমদানিতে বেশ চাঙ্গাভাব ছিল।

দুই দফা বন্যায় উৎপাদন কমায় চাল আমদানি বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে, যা এখনও অব্যাহত আছে। এর সঙ্গে জ্বালানি তেল, মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও বেশ বেড়েছে।

গত অর্থবছরের ৪৭ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে আমদানি ব্যয় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৯ শতাংশ বেড়েছে।

গত কয়েক বছর ধরেই মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) বাড়ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছিল ৩৮ শতাংশ। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ২৮ শতাংশ।

গত অর্থবছরে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি বেড়েছিল ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের চার মাসে বেড়েছে ১৬ দশমিক ২৯ শতাংশ।

অন্যদিকে রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক ধারা ২০১৭ সালেও বাংলাদেশ ধরে রাখতে পাওলেও গতি খুবই ধীর।

গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানি থেকে মোট ৩৪ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে মাত্র ১ দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি।

চলতি অর্থবছরের প্রাথম পাঁচ মাসে অর্থাৎ জুলাই-নভেম্বর সময়ে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এই হার শেষ পর্যন্ত এই রকমই থাকবে বলে মনে করছেন তৈরি পোশাক খাতের শিল্পদ্যোক্তা আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ।

তিনি বলেন, “২০১৭ সালের প্রথম দিকে রপ্তানি আয়ের গতি বেশ খারাপ ছিল। শেষের দিকে এসে বেড়েছে। তাতে খুব একটা প্রবৃদ্ধি হবে না। ৬/৭ শতাংশের মতো হবে হয়তো।”

 

ব্রেক্সিট এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্পের কিছু সিদ্ধান্তের কারণে বিশ্ব রপ্তানি বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা রয়েছে বলে মনে করেন পারভেজ।

“এছাড়া ২০১৮ সালের শেষে আমাদের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিদেশি ক্রেতারা আগে থেকে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। ইলেকশনকে কেন্দ্র করে ফের রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয় কী না-এ আশঙ্কায় তারা অর্ডার কমিয়ে দিচ্ছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দরের সমস্যা তো আছেই।”

বাংলাদেশ ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষ করেছিল বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) ১ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে।

তবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ের যে তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করেছে, তাতে লেনদেন ভারসাম্যে সেই ঘাটতি প্রায় আড়াই গুণ বেড়ে ৩ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে।

রেমিটেন্সে খরা কাটছে

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি বিদেশে থাকা কর্মীদের পাঠানো অর্থ। তাতেই খরা দেখা গেলেও সম্প্রতি তা কাটতে শুরু করেছে।

গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ১২ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা আগের বছরের চেয়ে ১৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ কম।

তবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ৫ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স দেশে এসেছে। এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি।

আর চলতি ডিসেম্বর মাসের ২২ দিনে (১ ডিসেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত) এসেছে ৮৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ে ধীর গতি রয়েছে উল্লেখ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, “রপ্তানি আয়ে লক্ষ্য পূরণ হবে বলে মনে হচ্ছে না। অন্যদিকে আমদানি বেড়েছে ২৮ শতাংশের বেশি, যার ফলশ্রুতিতে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্সে (বিওপি) সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের মতো ঘাটতি দেখা দিয়েছে।”

ফাইল ছবি

 

মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা

আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের দর প্রায় ৮৩ টাকায় উঠেছে; ব্যাংকগুলো এর থেকেও দেড়-দই টাকা বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে।

গত বছরের ২০ ডিসেম্বর আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজারে ১ ডলার কিনতে ৭৮ টাকা ৮৫ পয়সা খরচ করতে হয়েছিল। এই বছরের ২০ ডিসেম্বর সেই ১ ডলারের জন্য লেগেছে ৮২ টাকা ৭০ পয়সা।

এভাবে ডলারের বিপরীতে টাকার দর কমায় রেমিটেন্স এবং রপ্তানি খাত লাভবান হলেও আমদানি খরচ বাড়ছে।

বিনিয়োগে গতি

দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে। এরই মধ্যে অর্ধেক শেষ হয়েছে বলে সরকারিভাবে দাবি করা হচ্ছে। মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হয়েছে; রাজধানীতে মেট্টোরেলের কাজও এগিয়ে চলছে। বিদুৎ ও গ্যাস- দুই খাতে সরকার প্রচুর বিনিয়োগ করাউৎপাদন বেড়েছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেনের কাজ সম্পন্নসহ আরও কিছু বড় অবকাঠামো প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি দেশবাসীকে আশা জাগিয়েছে।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরও সুখবর হচ্ছে, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়ে প্রায় ১৯ শতাংশে পৌঁছা। যদিও এর সদ্ব্যবহার নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে উদ্বেগ আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের জুন-ডিসেম্বর মেয়াদের মুদ্রানীতিতে ব্যাক্তি খাতে ঋণপ্রবাহের লক্ষ্য ধরা ছিল ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। অক্টোবর শেষে তা ১৮ দশমিক ৬৩ শতাংশে পৌঁছেছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হারও কমতির দিকে।

গত অর্থবছরে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার ছিল ৯০ শতাংশের উপরে। চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) এডিপি বাস্তবায়নের হার ২৫ শতাংশের মতো।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছিল, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সময়ে বাংলাদেশ ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারের এফডিআই পেয়েছে। এই অংক গত বছরের একই সময়ে চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি।

দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে। সব মিলিয়ে বিনিয়োগের অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

২০১৮ সালে এই অনুকুল পরিবেশ বিরাজ করলে বাংলাদেশ আরও দ্বিগুণ গতিতে এগিয়ে যাবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।

তবে বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারের পিপিপি (সরকারি-বেসরকারি অংশিদারিত্ব) উদ্যোগ এখনও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।