তিনি বলেছেন, “খেলাপি ঋণের মাত্রার পরিমাণে পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় অনেক ভালো অবস্থায় আমরা আছি।”
২০১৫ সালে বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ৯ শতাংশের (মোট বিতরণ করা ঋণের) নিচে ছিল। ২০১৬ সালে তা ১০ শতাংশ অতিক্রম করে। একে দেশের ব্যাংক খাতের জন্য উদ্বেগের বিষয় বলে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে।
বর্তমানে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই খেলাপি ঋণের মধ্যে প্রকৃত খেলাপি ঋণ হচ্ছে ৮০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৪৫ হাজার কোটি টাকা অবলোপন (রাইট অফ) করা; যা পাওয়ার আশা নেই বললেই চলে।
ঢাকার লেইক শোর হোটেলে বুধবার বিআইডিএস আয়োজিত দুদিনব্যাপী ‘রিসার্চ এলামনাক ২০১৭’ শীর্ষক সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বক্তব্যে খেলাপি ঋণের প্রসঙ্গটি আনেন ফরাসউদ্দিন।
সাবেক এই গভর্নর বলেন, “এটাকে (খেলাপি ঋণ) সমাধান করা খুব কঠিন বলে মনে করি না। ফর্মুলা রয়েছে, যার মাধ্যমে এটাকে সমাধান করা যায়।”
অনুষ্ঠানে সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান বলেন, খেলাপি ঋণের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
ফরাসউদ্দিন বলেন, “বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এত সম্প্রসারিত হয়েছে যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক তার অর্ধেকও সম্প্রসারিত হয় নাই।”
ব্যাংক খাতের পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাবনার দিক দিয়ে অনুষ্ঠানে কথা বলেন তিনি।
ফরাসউদ্দিন বলেন, স্বাধীনতার পর আমাদের অর্জনের পাল্লাটা বেশ ভারী। ৩ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি এখন ২৫০ বিলিয়নে উন্নীত হয়েছে। ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট আজ ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার। মাথাপিছু আয়ে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাওয়া অবশ্যই কৃতিত্বের।
দুই দেশের তুলনা করে তিনি বলেন, “আমাদের মাথা পিছু আয় পাকিস্তানের চেয়ে ৬৮ ডলার বেশি এবং এটা বাড়তে থাকবে। কারণ আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩ শতাংশ, আর পাকিস্তানের ২ দশমিক ৫ শতাংশ।”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য নিয়ে যারা সন্দেহ করেন, তাদের জন্যও এটা জবাব বলে মন্তব্য করেন ফরাসউদ্দিন।
“অনেকে বলেন, বিবিএস মিথ্যা তথ্য দেয়। অথচ এখানে আমরা দেখলাম সর্বশেষ হিসাবে বিবিএস বলেছে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১৫১০ ডলার, আর ইকোনমিস্ট বলছে ১৫৩৮ ডলার।”
বাজার অর্থনীতি গ্রহণ করলেও শেখ হাসিনাকে ফরাসউদ্দিন সাধুবাদ দেন জাতির জনকের নীতি ধরে রাখার জন্য।
অর্থনীতির সামনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে ফরাসউদ্দিন বলেন, আগামীতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারই মূল বাজার হয়ে উঠতে পারে বলে তা নিয়ে গবেষণা চালানো প্রয়োজন।
রপ্তানি বহুমুখীকরণে জোর দিয়ে তিনি পণ্যমান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিএসটিআইকে বিশ্বমানে উন্নীত করার পরামর্শ দেন।
“যদি এধরনের প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বমানে উন্নীত করা যায়, তাহলে আমরা অনেক মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছ থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি।”
বিদ্যুৎ উৎপাদনের শতভাগ সরকারি উদ্যোগে করার পক্ষপাতি ফরাসউদ্দিন।
“বেসরকারিভাবে দেওয়া উচিৎ নয়। কারণ রাজনীতিতে যিনি আজকে সরকারের বন্ধু, তিনি আগামীকাল বা সরকার পরিবর্তন হলে যে সরকারের বিপক্ষের লোক হয়ে যাবেন না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই আমি মনে করি, এই একটি সেক্টরে সরকারের প্রাধান্য থাকা উচিৎ।”
এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “জাতির পিতা যদি ১৯৭৩ সালে গ্যাস কোম্পানিগুলোকে জাতীয়করণ না করতেন তাহলে আজকে কী অবস্থা হত, তা চিন্তা করা যায় না।”
বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে চামড়া, ওষুধ, সিরামিক, পর্যটন, খেলাধুলার সরঞ্জাম, মোটর সাইকেলের সঙ্গে পাটের সুদিন ফিরে আসার কথাও বলেন ফরাসউদ্দিন।
“২০০৩ সালে যদি প্রায় বিনামূল্যে আদমজি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া না হত, তাহলে এখন কিন্তু অনেক বড় শিল্প হয়ে উঠতে পারত। এখন সোনালী আঁশ নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। অনেক পণ্য তৈরি করা হচ্ছে।”
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান রেমিটেন্সে অর্থ বিনিয়োগে আনার উপর জোর দেন।
তিনি বলেন, “আমাদের ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি জ্ঞাননির্ভর প্রশাসন দরকার। বর্তমানে আমাদের অর্থনীতি জ্ঞাননির্ভরভাবে পরিচালিত হচ্ছে না।”
এর একটি উদাহরণ দিয়ে মসিউর বলেন, “বর্তমানে আমাদের ইট রপ্তানিতে সবচেয়ে বেশি ইনসেনটিভ দেওয়া হয়। অথচ এই ইট তৈরি করতে যে মাটি ব্যবহার করা হয়, তা আমাদের মাটির উর্বরতা নষ্ট করে।”
সাইদুজ্জামান বলেন, “আমাদের মধ্য ও উচ্চ আয়ের দেশে যেতে হলে অবশ্যই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বর্তমান পরিস্থিতির উন্নয়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির কোনো বিকল্প নেই।”
দাতাদের প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড় নিশ্চিত করার পাশাপাশি তার যথাযথ ব্যবহারের উপরও জোর দেন সাবেক এই মন্ত্রী।
বিআইডএস মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।