রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে ‘অর্থনৈতিক কূটনীতিও’ চান আবুল বারকাত

রোহিঙ্গা সঙ্কটে রাজনৈতিকভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতি চালানোর পরামর্শও দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাত।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Sept 2017, 08:42 AM
Updated : 29 Sept 2017, 08:42 AM

শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “যদিও আমরা কূটনীতিবিদ না, রাজনৈতিক কূটনীতি দিয়ে পুরো সমস্যার সমাধান হবে বলে আমরা মনে করি না। রাজনৈতিক কূটনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতি, ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি যেটা, চালানো ভাল হবে।”

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নের প্রতিবাদে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে একথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক বারকাত।

দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক তৎপরতা চালানোর পাশাপাশি ‘গ্রিন রুমের’ কূটনীতিকে কাজে লাগানোর কথা বলেন অর্থনীতি সমিতির সাবেক এই সভাপতি। একইসঙ্গে দেশীয় ঐক্য ধরে রাখার পরামর্শ আসে তার কথায়।

অধ্যাপক বারকাত বলেন, “আলোচনা দ্বিপাক্ষিক করতে হয়, বহুপাক্ষিকও করতে হয়। এ বিষয়গুলো কাজে লাগে আমি জানি। আনুষ্ঠানিক আলোচনা যখন হয়, অনেকে অনেক কথা বলেন, অনেক মত দেন, অনেক ভাল কথা বলেন। কিন্তু আসল কাজটা হয় গ্রিন রুমে।

“‘গ্রিন রুম পলিটিক্স’ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কূটনীতির; গ্রিন রুম পলিটিক্সে আমরা কতটুকু ভাল করব, সেটা একটা বিষয়। অভ্যন্তরীণভাবে আমরা কতটুকু গণতন্ত্র ও বৈশ্বিক বিষয়ের চর্চা করব, সেটা একটা বিষয়। কারো কাছে গিয়ে যদি বলি এটা নিয়ে, তারা যদি বলে তোমাদের নিজের মধ্যেও তো এই প্রবলেম আছে।”

বিভিন্ন দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে বিশ্ব জনমত গঠনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “এটা কেবল অর্থনৈতিক বিষয় নয়। এটার যে পরিবেশগত প্রভাব সেটাও আছে, সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘ থেকে বক্তব্য এসেছে।

“আমরা একটা কথা বলছিলাম, আসিয়ান অঞ্চলের যে দেশগুলো, প্রভাবটা পড়েছে। সেজন্য তাদের সম্পৃক্ত করতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে।”

কৌশলগত কারণে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো নিজের অবস্থান ব্যক্ত করছে জানিয়ে আবুল বারকাত বলেন, “পৃথিবীতে চারটি কৌশলগত সম্পদ, ভূমি, জলা-সাগর, খনিজ জ্বালানি সম্পদ এবং স্পেস মহাকাশ। এই চারটা সম্পদের উপর অ্যাবসোলিউট ওনারশিপ, অ্যাবসোলিউট কনট্রোল এটা নিশ্চিত করতে চায় বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হোতা সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি একক কোনো সিস্টেম না।

“পেরি-ইম্পেরিয়ালিজম, সেমি-ইম্পেরিয়ালিজম, কম্পিটেটিভ ইম্পেরিয়ালিজম তৈরি হচ্ছে। এটা চীন, রাশিয়া, ভারত- এটা কম্পিটেটিভ ইম্পেরিয়ালিজম কি-না? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে এসব এলাকায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ থেকে শুরু করে, মুক্তবাণিজ্য প্রভৃতিকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে।”

চীন-ভারতের স্বার্থের কথা উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “চীনের বিনিয়োগ বেশি মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্টে। বিনিয়োগ কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার। ভারতের বিনিয়োগ আছে কয়েক বিলিয়ন ডলার। এটা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের যে প্রাকৃতিক সম্পদ, গ্রেসিয়াম, ইউরেনিয়ামসহ যেগুলো আছে। আবার বঙ্গোপসাগরের সংযোগকারী।”

রাখাইন রাজ্যের ইউরোনিয়াম সবচেয়ে ‘গুণগত মানসম্পন্ন’ হওয়ায় বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মধ্যে এই নিয়ে প্রতিযোগিতা আছে বলে তথ্য দেন তিনি।

“সেখানে যে ইউরেনিয়ামসহ খনিজ সম্পদ... যে ইউরেনিয়ামে উপর চীনের নজর বহু আগে থেকেই, আর ওই দূর থেকে নজরে রেখেছেন কে... তিনি হয়তো উপর থেকে দেখছেন, এরা একটু মারামারি করুক। পরে আমি বলব, এই এত মারামারি কিসের, একটু দেখিত কী হল?”

রোহিঙ্গাদের শরণার্থী স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে সরকারি অবস্থানের সমালোচনা করেন অধ্যাপক বারাকাত বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শরণার্থী বলছেন, এখানে বলা হচ্ছে অনুপ্রবেশকারী। অনুপ্রবেশকারী বললে দায়-দায়িত্ব আসে না। শরণার্থীর একটা সংজ্ঞা আছে, আন্তর্জাতিক সভ্য সমাজে সদস্য হিসাবে আমাদের একটা দায়-দায়িত্ব থাকে, আমি তাদের শরণার্থী বলি। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় আর কি...

“নিঃসন্দেহে তারা শরণার্থী। তাদের শরণার্থীর মর্যাদা দিতে হবে। তারাতো এমনি এমনি চলে আসেনি। তিন দিনে ৮০২টি শিশু, যাদের বাবাকে হত্যা করা হয়েছে।”

লিখিত বক্তব্যে মিয়ানমার সরকারের প্রতি রাখাইনে হত্যাযজ্ঞ বন্ধের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশকে এ হত্যাযজ্ঞ বন্ধে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানান আবুল বারকাত।

তিনি বলেন, “আমরা ভারত, গণচীন, রাশিয়া, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সকল বৃহৎ ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দের কাছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বিরোধী হত্যাযজ্ঞ বন্ধ এবং বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের অবিলম্বে তাদের নিজ দেশে ফেরত নেওয়ার জন্য সর্বাত্মক কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ ও প্রভাব বিস্তারের আহ্বান জানাচ্ছি।”

আবুল বারকাত আরও বলেন, “মিয়ানমারে চলমান রোহিঙ্গা-বিরোধী নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে ওখানকার স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবিতে সোচ্চার হতে হবে।”

এ প্রসঙ্গে মিয়ানমার পৃথিবীর দশম বৃহৎ সামরিক বাহিনীর দেশ হওয়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

রোহিঙ্গা নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে ‘ওখানকার স্বৈরশাসক-যুদ্ধাপরাধীদের বিদেশে ব্যাংক হিসাব জব্দ’ করার দাবি জানান এই অর্থনীতিবিদ।

রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে- এমনটা মনে করার কারণ নেই বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক বারকাত।

তিনি বলেন, “এই সমস্যা মোকাবেলার জন্য দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় কর্মপরিকল্পনা এবং এদের দেশে ফেরত পাঠাতে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে বহুমুখী-বহুমাত্রিক কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য সরকার, গণমাধ্যম এবং সকল স্তরের নাগরিক সমাজের যৌথ কর্মপন্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের সক্রিয় করে তুলতে হবে।”

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।