প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬.৪%: বিশ্ব ব্যাংক

চলতি অর্থবছরে সরকার ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ঠিক করলেও শেষ পর্যন্ত তা ৬ দশমিক ৪ শতাংশের বেশি হবে না বলেই মনে করছে বিশ্ব ব্যাংক।

প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Sept 2017, 07:20 AM
Updated : 27 Sept 2017, 01:40 PM

আন্তর্জাতিক এই ঋণদাতা সংস্থার ষান্মাষিক প্রতিবেদন ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’- এ বুধবার এই পূর্বাভাস তুলে ধরে বলা হয়, দুই দফা বন্যার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় কৃষি খাতে এবার প্রবৃদ্ধি কম হবে। তবে শিল্প ও সেবা খাতের ওপর ভর করে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেতে পারে বাংলাদেশ।

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে এই প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সংস্থার প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “প্রবৃদ্ধির এই প্রাক্কলন একমাত্র ভারত ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি। আন্তর্জাতিক মূল্যায়নে এটা খুবই ভালো প্রবৃদ্ধি। ভারতে এবার ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন দেওয়া হয়েছিল, সেটাও হয়ত থাকবে না।”

চলতি অর্থবছর চীন ৬ দশমিক ৩, ইন্দোনেশিয়া ৫ দশমিক ৩, থাইল্যান্ড ৩ দশমিক ৩, পাকিস্তান ৫ দশমিক ৫ প্রবৃদ্ধি পেতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে।

প্রায় এক দশক ৬ শতাংশের বৃত্তে ‘আটকে’ থাকার পর গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ‘ঘর’ অতিক্রম করে। চূড়ান্ত হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয় ৭ দশমিক ১১ শতাংশ।

এরপর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরে এগিয়ে বাংলাদেশ অর্জন করে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।

চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে সরকার ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ঠিক করেছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলে আসছেন, প্রবৃদ্ধির হার আর কখনও ৭ শতাংশের নিচে নামবে না বলেই তার বিশ্বাস। 

বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে জাহিদ হোসেন বলেন, “রপ্তানি খাত এখন ভালো করছে। গত অর্থবছরে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এবার প্রথম দুই মাসের যে তথ্য পাওয়া গেছে তা ভালোর দিকেই যাবে বলে মনে হচ্ছে।”

২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানিতে ৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেলেও চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই ও অগাস্টে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি আয় হয়েছে।

চলতি অর্থবছরে ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ৩ হাজার ৭৫০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য ঠিক করেছে বাংলাদেশ সরকার।

রপ্তানির পাশাপাশি রেমিটেন্স প্রবাহে গত অর্থবছর বড় ধাক্কা খেয়েছিল বাংলাদেশ। রেমিটেন্স কমেছিল ১৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এবার তা ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছে বিশ্ব ব্যাংক।  

জাহিদ হোসেন বলেন, “জনশক্তি রপ্তানি এবার বেশ বেড়েছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির একটি লক্ষণ দেখা দিয়েছে, কারণ ব্যাংক ঋণের সুদের হার কিছুটা কমেছে।”

এছাড়া সেবা ও শিল্প খাতের ওপর ভর করে বাংলাদেশ চলতি অর্থবছরে ৬ দশমিক ৪ প্রবৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা প্রকাশ করেন তিনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অবকাঠামো উন্নয়ন ও মানসম্মত কর্মসংস্থান তৈরিই হবে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ।

আর নির্বাচনের আগের বছর হওয়ায় এবার বড় ধরনের সংস্কারের সম্ভাবনা কম থাকা, বড় বড় বাজারে রপ্তানি কমে যাওয়া এবং রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব অব্যাহত থাকা, ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব এবং বিশাল অংকের খেলাপি ঋণকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি বলে মনে করছে বিশ্ব ব্যাংক।

মূল্যস্ফীতিতে সতর্ক সংকেত

বন্যায় কৃষি উৎপাদন কম হওয়ায় এবং বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে ধারণা করছে বিশ্ব ব্যাংক।

জাহিদ হোসেন বলেন, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়েই ছিল। গত অর্থবছর শেষে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছিল। এবার তা ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

‘অপ্রত্যাশিত চাপ’

খাদ্যে ভর্তুকি এবং মিয়ারমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ত্রাণের সংস্থান করার বিষয়টিকে চলতি বছরের বাজেট বাস্তবায়নে ‘অপ্রত্যাশিত চাপ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে। 

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে জাহিদ হোসেন বলেন, মজদু কমে আসায় সরকারকে এবার প্রচুর চাল আমদানি করতে হবে। বেশি দামে চাল কিনে কম দামে সরবরাহ করতে হবে। শরণার্থীদের জন্য খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।

“সে কারণে এবার খাদ্য খাতে মোটা অংকের ভর্তুকি দিতে হতে পারে। তাতে বাজেটের ওপর চাপ পড়বে।”

চালের দাম বেড়েছে ‘সিদ্ধান্তহীনতায়’

সাম্প্রতিক সময়ে চালের দর বৃদ্ধির পেছনে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতাকে দায়ী করেছেন জাহিদ হোসেন।

তিনি বলেন, “বন্যার কারণে চালের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার কারণেই দামে বেশি প্রভাব পড়েছে।”

হাওড় অঞ্চলে প্রথম পর্যায়ের বন্যায় ৮ থেকে ১০ লাখ টন চাল উৎপাদন কম হয়েছে। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০ লাখ টন উৎপাদন কম হয়েছে।

সব মিলিয়ে ৩০ লাখ টন চালের ঘাটতি কীভাবে মেটানো হবে- সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের ‘দুর্বলতা’ দেখতে পাচ্ছেন বিশ্ব ব্যাংকের এই অর্থনীতিবিদ।

“সরকার চাল আমদানি করবে, নাকি স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করবে? আবার আমদানি করলে সেটার নীতি কী হবে? সরকার সরাসরি কতটা আমদানি করবে? বেসরকারি পর্যায়ে কী পরিমাণ আনা হবে? এ সব প্রশ্নেই সিদ্ধান্তহীনতা ছিল। শুল্ক কমাতেও অনেক দেরি হয়েছে।”

আর সাম্প্রতিক সময়ে চালের দর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ‘গুজব’ একটি বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মন্তব্য করেন জাহিদ হোসেন।

তিনি বলেন, “ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে- এ গুজব ছড়ানোর পর হু হু করে চালের দাম বেড়ে গেল।”

সামগ্রিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে জাহিদ হোসেন বলেন, ভারত, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে চালের দাম গত কিছুদিনে বেড়েছে। আর দেশে সরকারের গুদামেও চালের ঘাটতি ছিল।

এরই মধ্যে বন্যায় ফসলহানী ঘটে; কেবল সেপ্টেম্বর মাসেই ভালো মানের চালের দাম আট থেকে দশ টাকা বেড়ে যায়।

বরাবরের মতো এবারও চালের দাম বৃদ্ধির জন্য মিল মালিক ও আড়তদারদের দায়ী করে সরকার।

“কিন্তু আমাদের বিবেচনায়, বাজার মনিটরিংয়ের যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্তহীতাই চালের দাম বাড়ার মূল কারণ ছিল।”