তাদের ‘গ্লোবাল কমপেটিটিভনেস রিপোর্ট ২০১৭-১৮’ বলছে, এবার ১৩৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ৯৯তম অবস্থানে। আগের বছর এক ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ ১০৬ এ পৌঁছেছিল।
চলতি বছরের শুরুতে চালানো জরিপের ভিত্তিতে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বুধবার বিশ্বব্যাপী একযোগে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে ফোরামের পক্ষে বাংলাদেশে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
একটি দেশের অবস্থান বিচারের জন্য প্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো, সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও প্রাথমিক শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, পণ্য বাজারের দক্ষতা, শ্রম বাজারের দক্ষতা, আর্থিক খাতের উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি, বাজারের আকার; বাজারের সংবেদনশীলতা এবং নতুন ধারণার প্রবর্তন- এই ১২টি মানদণ্ড ব্যবহার করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম।
সব মিলিয়ে এবার বাংলাদেশের স্কোর হয়েছে ৩ দশমিক ৯, যা গতবছর ৩ দশমিক ৮ ছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরেও বাংলাদেশের স্কোর ৩ দশমিক ৮ ছিল। তার আগের তিন বছর ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৭, ৩ দশমিক ৭ ও ৩ দশমিক ৬।
সূচকের ১২টি মানদণ্ডের ভেতরে এবার প্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো, সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিবেশ, উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, আর্থিক খাতের উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি, বাজারের আকার; বাজারের সংবেদনশীলতা এবং নতুন ধারণার প্রবর্তন- এই নয়টিতে বাংলাদেশের স্কোর বেড়েছে।
এছাড়া স্বাস্থ্য ও প্রাথমিক শিক্ষা, পণ্য বাজারের দক্ষতা, শ্রম বাজারের দক্ষতা মানদণ্ডে স্কোর হয়েছে গতবারের সমান। কোনো মানদণ্ডেই এবার বাংলাদেশের অবনতি হয়নি।
গতবারের মত এবারও ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সূচকে শীর্ষস্থানে রয়েছে সুইজারল্যান্ড, তাদের স্কোর ৫ দশমিক ৮৬। এরপরই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, হংকং, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, জাপান ও ফিনল্যান্ড।
এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কেবল পাকিস্তান ছাড়া সবাই আছে বাংলাদেশের উপরে।
এক ধাপ পেছালেও ভারতের অবস্থান এবার রয়েছে ৪০ নম্বরে। ভুটান ৯৭ থেকে উঠে এসেছে ৮২ নম্বরে। শ্রীলঙ্কা ৭১ থেকে পিছিয়ে ৮৬ তম অবস্থানে চলে গেছে। নেপাল ৯৮ থেকে এগিয়ে ৮৬তম অবস্থানে এসেছে। আর পাকিস্তান ১২২ থেকে উঠে এসেছে ১১৫ নম্বরে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এবার মোটামুটি ভালো করলেও তথ্য-প্রযুক্তি অবকাঠামোর উন্নয়ন এ অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম ২০০১ সাল থেকে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। সিপিডি বাংলাদেশে বৈশ্বিক এই ফোরামের সহযোগী হিসেবে কাজ করে।
ঢাকায় এ প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “আমরা বহু আগে থেকেই বলে আসছিলাম, তালিকার মধ্যম সারির দেশের কাতারে যাওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে।”
অবকাঠামো ও প্রতিষ্ঠান- এ দুই মানদণ্ডে বাংলাদেশের উন্নতিকে এবারের সূচকে বাংলাদেশের সাত ধাপ অগ্রগতির পেছনে ‘প্রধান কারণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি।
এর মধ্যে প্রতিষ্ঠান ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ গতবারের ১২৫তম অবস্থান থেকে এবার ১০৭ এ উঠে এসেছে। আর অবকাঠামোতে বাংলাদেশের অবস্থান এবার ১১১তম, যা গতবছর ১১৪তম ছিল।
তবে বাংলাদেশের জন্য দক্ষতা বৃদ্ধিকে আগামী দিনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বর্ণনা করে মোয়াজ্জেম বলেন, এবারের সূচকে দক্ষতা সংক্রান্ত সব মানদণ্ডেই বাংলাদেশের অগ্রগতি কম।
জরিপে দুর্নীতিকে বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও গতবারের ১৬ দশমিক ৫ থেকে এবার পয়েন্ট কমে ১৫ দশমিক ৭০ পয়েন্ট হয়েছে। এই হিসেবে বাংলাদেশে সার্বিকভাবে দুর্নীতি কমেছে বলে মনে করছেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক।
তিনি বলেন, “সম্প্রতি অবকাঠামো খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেও সমস্যার তালিকায় এক বা দুই নম্বর থেকে এ দুটো বিষয়কে আমরা নামিয়ে আনতে পারিনি। এটা ভেবে দেখা দরকার। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবার সামনে চলে এসেছে, কারণ ব্যবসায়ীরা এ জটিলতার কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না।”
তিনি বলেন, “আমরা এখনো প্রযুক্তিগত প্রস্তুতিতে যথেষ্ট পিছিয়ে আছি। চলমান ব্যবসার মডেল পরিবর্তন করতে হবে। সকল ধরনের লেনদেন আইসিটি ভিত্তিক হতে হবে।”
কালিয়াকৈর হাই টেক পার্কসহ আইসিটি খাতের বেশ কয়েকটি প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারাকে ‘ব্যর্থতা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে।
মোয়াজ্জেম বলেন, নব্বইয়ের দশকে ভারত সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে দেশটি এখন প্রায় ১১৪ বিলিয়ন ডলারের সফটওয়্যার রপ্তানি করে। আর বাংলাদেশ ২০০০ সালে নেওয়া সিদ্ধান্ত এখনো বাস্তবায়ন করতে না পারায় অনেক সম্ভাবনা থাকার পরও রপ্তানির পরিমাণ মাত্র ২৪ কোটি ডলার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৪২ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ ইতিবাচক। তবে পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল না পেলে তারা সংশয় থেকে বের হতে পারবেন না। একইসঙ্গে কর্পোরেট গভর্ন্যান্স সৃষ্টি করতে হবে। মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন করতে হবে।
এছাড়া দেশের আর্থিক খাতের উন্নয়নে একটি কমিশন গঠনেরও পরামর্শ দেওয়া হয় সংবাদ সম্মেলনে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে সংস্থার সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ও গবেষণা পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।