মাতারবাড়িতে কাজ এগোচ্ছে; দৃশ্যমান ‘দেড় বছরেই’

কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ নিয়ে সংশয় কাটিয়ে চুক্তি হওয়ার পর এখন কাজ এগিয়ে চলছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের একজন শীর্ষ কর্তা।

রিয়াজুল বাশার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 August 2017, 01:11 PM
Updated : 27 August 2017, 01:30 PM

জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে মাতারবাড়িতে নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র; ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই কেন্দ্রের কাঁচামাল হবে কয়লা।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী বলেন, মাতারবাড়ি হবে বাংলাদেশের ‘বিদ্যুৎ হাব’।

ভবিষ্যতে এই দ্বীপে যাতে সিঙ্গাপুরের চেয়ে উন্নত অবকাঠামো তৈরি করা যায়, সেজন্য জাপানি বিনিয়োগকারীদের আহ্বান জানান তিনি।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি দেশের প্রথম সমুদ্রবন্দরও নির্মাণ করে মাতারবাড়িকে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।

গত বছর গুলশান হামলার প্রভাব পড়েছিল মাতারবাড়ি প্রকল্পেও। তার অবসান ঘটিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে গত মাসে জাপানের তিনটি প্রতিষ্ঠানের একটি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তি করে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ (সিপিজিসিবিএল)।

প্রকল্পের মূল কাজের ঠিকাদার নিয়োগ ছাড়াও সড়ক নির্মাণ, টাউনশিপ গড়ে তোলার মতো আনুষঙ্গিক কাজও এগিয়ে চলছে বলে সিপিজিসিবিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম।

তিনি শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অর্থনৈতিকভাবে প্রকল্পের ৩ শতাংশ এবং সার্বিকভাবে ১৫ শতাংশ কাজের অগ্রগতি হয়েছে।”

প্রকল্পের কাজ দৃশ্যমান হতে এক থেকে দেড় বছর সময় লাগবে বলে জানান আবুল কাশেম।

“আগামী মাস থেকেই বিদেশি প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা আসতে শুরু করবে। আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্পের মূল কাজ দৃশ্যমান হতে এক থেকে দেড় বছর লেগে যেতে পারে।”

বাংলাদেশের মানচিত্রে মাতারবাড়ির অবস্থান (ছবি: বিদ্যুৎ বিভাগ)

মহেশখালীর মাতারবাড়ি ও ঢালঘাটা ইউনিয়নের ১৪১৪ একর জমিতে এই বিদ্যুত প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ ২০২৩ সালের অক্টোবরে শেষ করার আশা করছে সরকার।

তবে জাপানি কনসোর্টিয়ামের অন্যতম কোম্পানি তোশিবা করপোরেশন সম্প্রতি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ২০২৪ সালের জুলাইয়ের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

প্রকল্পের খরচের পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা হবে বলেও জানায় তারা।

সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যে বাস্তবায়নাধীন যে ১০টি প্রকল্প রয়েছে তার মধ্যে খরচের দিক দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরই রয়েছে মাতারবাড়ির প্রকল্পটি।

২০১৫ সালের অগাস্টে মাতারবাড়িতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ৩৬ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। একনেকে অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পের কার্যপত্রে বলা হয়, জাইকা এই প্রকল্পে ২৯ হাজার কোটি টাকা দেবে।

মাতারবাড়িতে পরিকল্পিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র (ছবি: বিদ্যুৎ বিভাগ)

দরপত্র প্রক্রিয়া চলার মধ্যেই গত বছরের জুলাইয়ে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় জাপানি প্রকৌশলীসহ ১৭ জন বিদেশি নিহত হওয়ার পরদিন মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দরপত্র প্রক্রিয়া স্থগিত করার কথা জানায় সরকার। এরপর জাইকার সবচেয়ে বড় এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে তৈরি হয় সংশয়।

কিন্তু সে সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে গত গত ২৭ জুলাই জাপানি কনসোর্টিয়াম সুমিতোমো করপোরেশন, তোশিবা করপোরেশন ও আইএইচআই করপোরেশন-এর সঙ্গে চুক্তি করে সিপিজিসিবিএল।

ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক এবং আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ একটি গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রয়োজনীয়তা অনেকদিন থেকেই দেখা দিয়েছে।

বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার মহেশখালীর সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের প্রকল্প অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর মধ্যে রাখলেও তার কোনো অগ্রগতি হয়নি।

গত সাত বছরে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি ২০০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। দুটি বন্দর দিয়ে ক্রমবর্ধমান এ বাণিজ্য সামাল দেওয়া প্রায় ‘অসম্ভব’ হয়ে উঠেছে। তাই গভীর সমুদ্র বন্দরে নির্মাণে সরকারের পক্ষ থেকেও জোরেশোরেই কাজ করতে হচ্ছে।

মানচিত্রে মাতারবাড়িসহ মহেশখালী ঘিরে সরকারের পরিকল্পিত এলাকা (ছবি: বিদ্যুৎ বিভাগ)

মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আমদানি করা কয়লানির্ভর হওয়ায় কয়লা আনার জন্যই এই বন্দর করা হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। ৫৯ ফুট গভীর এই বন্দরে ৮০ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার জাহাজ ভিড়তে পারবে।

তোশিবা করপোরেশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জাপানের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে মাতাবাড়ির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে যে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মিত হবে সেটি হবে জাপানের কাশিমা বন্দরের মতো করে।

গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মিত হলে কয়লা পরিবহন ছাড়াও অন্যান্য কী কাজে ব্যবহার করা যাবে-এ প্রশ্নের জবাবে আবুল কাশেম বলেন, “আপাতত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথা মাথায় রেখেই আমরা এটা করছি। তবে এই বন্দরকে বহুমুখী ব্যবহার করা যায় কি না, তা নিয়ে জাইকা স্টাডি করছে।”

অধিগ্রহণ করা জমির ক্ষতিপূরণ হস্তান্তর অনুষ্ঠান (ফাইল ছবি)

বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার জন্য বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে মহেশখালীর ছয়টি মৌজায় যেসব জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে সেসব জমি বসতি-বৃক্ষহীন। ধু ধু জমিতে গ্রীষ্মকালে লবণ ও বর্ষায় চিংড়ি চাষ হয়।

আবুল কাশেম বলেন, “আমরা যেসব জমি অধিগ্রহণ করেছি তার জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিয়েছি। এছাড়া সরকারি জমির উপর ৩০ থেকে ৩৫টি ঘর ছিল। তার জন্যও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।”

মহেশখালীতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, গভীর সমুদ্র বন্দর ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) টার্মিনাল স্থাপন করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও নগর গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছে সরকার, যাতে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে আশা দেওয়া হচ্ছে।