বাজেটে কর প্রস্তাবে যে সব পরিবর্তন

নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না করার পাশাপাশি অন্যান্য কয়েকটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের কর প্রস্তাবে পরিবর্তন এনে সংসদে পাস হয়েছে অর্থবিল ২০১৭।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 June 2017, 04:01 PM
Updated : 28 June 2017, 04:43 PM

২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটের উপর বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলোচনার পর তার সুপারিশের আলোকে কিছু পরিবর্তন এনে অর্থবিল পাসের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

আগামী বছরের জন্য ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ের ফর্দ ধরে গত ১ জুন সংসদে বাজেট প্রস্তাব করেছিলেন তিনি।

টানা নয়টি জাতীয় বাজেট দেওয়া ৮৪ বছরের মুহিতের কাছে এটি নিজের ‘সেরা বাজেট’ মনে হলেও এটি নিয়েই সবচেয়ে বেশি সমালোচনা সইতে হয়েছে তাকে, বিশেষ করে ভ্যাট আইন ও ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্ক নিয়ে।

সংসদে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার পর বুধবার প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্যের পর মুহিত তার সংশোধিত প্রস্তাব তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “রাজস্ব প্রস্তাব সম্বন্ধে বিভিন্ন মহল থেকে শুল্ক-করাদি বাড়ানো অথবা কমানো অথবা বাদ দেওয়ার জন্য অনেক প্রস্তাব গত কয়েক মাসে পেয়েছি। জাতীয় সংসদের আলোচনায় এই সব প্রস্তাবের অনেকগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

“এইসব প্রস্তাবের বেশিরভাগই বাজেট চূড়ান্তকরণের সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরার্মশ ও নির্দেশনা আমরা গ্রহণ করেছি। তারই একটি তালিকা পেশ করছি।”

এরপর তার সংশোধিত প্রস্তাবসহ অর্থবিল কণ্ঠভোটে পাস হয়।

অর্থবিলের উপর সরকারি দলের হুইপ শহীদুজ্জামান সরকার ও মো. শাহাব উদ্দিন এবং বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কয়েকজন সংসদ সদস্য কিছু সংশোধনী প্রস্তাব করেন। শহীদুজ্জামান ও শাহাব উদ্দিনের প্রস্তাব গৃহীত হলেও বাকি সব প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়।

বাজেট প্রস্তাব করছেন অর্থমন্ত্রী মুহিত (ফাইল ছবি)

বাজেট প্রস্তাবের পর ভ্যাট আইন কার্যকর নিয়ে তুমুল আলোচনা উঠেছিল; সেই সঙ্গে ছিল ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্ক হার বাড়ানো।

এতদিন অনড় থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ভ্যাট আইনের বাস্তবায়ন আরও দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্কও কমানো হয়েছে।

ভ্যাটের বিষয়ে মুহিত বলেন, “এ বিষয়ে মাননীয় সংসদ সদস্যগণ তাদের প্রাজ্ঞ মতামত দিয়েছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এই বিষয়ে পরার্মশ দিয়েছেন। এই প্রক্ষিতে আমি মূসক আইনের পূর্ণ কার্যকারিতা দুই বছর পিছিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করছি।”

আবগারি শুল্কের বিষয়ে তিনি বলেন, “লক্ষ্য করবেন শুধু এক কোটি টাকার ঊর্ধ্বে হিসাবে আবগারি শুল্কের হার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।”

আরও যেসব পরিবর্তন

>> কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনকে একটি সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম হিসেবে বিবেচনা করে ধ্যান বা যোগ সাধনা আগামী ২ বছর থাকবে ভ্যাটমুক্ত।

>> কম্পিউটার, সেলুলার ফোন এবং তার যন্ত্রাংশ এখন দেশে তৈরি হচ্ছে বলে এগুলোকেও থাকবে ভ্যাটমুক্ত।

>> মোটর সাইকেল শিল্পের উপর স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার হয়েছে।

>> মাইক্রোসফট বাংলাদেশ যেসব পণ্য বিনা আমদানি শুল্কে আনে, সেসব পণ্য থাকবে ভ্যাটমুক্ত।

>> বাংলাদেশে রেফ্রিজারেটর উৎপাদনকারীদের সম্পূরক শুল্কহার শতাংশের স্থলে ২০ শতাংশ হবে।

>> প্লাস্টিক ও গ্লাস ফাইবার নির্মিত এলপিজি কন্টেইনারের আমদানি পর্যায়ে কোনো ভ্যাট থাকবে না। তবে লোহার এলপিজি কন্টেইনারে ভ্যাট থাকবে আগের মতোই।

>> মোটর সাইকেলের সব যন্ত্রপাতি উৎপাদনে বর্ধিত শুল্ক করাদি মওকুফ হবে। প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানি পর্যায়ে শুল্ককর হ্রাস হবে।

>> সোলার প্যানেলের উপর যে আমদানি শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা আর নেই।

>> তৈরি পোশাক খাতে উৎসে কর ১ শতাংশ বহাল থাকবে। তবে সবুজ কারখানার ক্ষেত্রে আয়কর হার ১০ শতাংশ এবং অন্যদের ক্ষেত্রে ১২ শতাংশ হবে।

কয়েকটি বিষয়ে আগামী অর্থবছরের শুরুতে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী

>> ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানির তামাক এবং সিগারেট বিষয়ক কর বাজেট পাস হওয়ার পর একটি এসআরও জারি করে নিষ্পত্তি করার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। ওই এসআরও জারির আগে গত ১ জুন, ২০১৭ তারিখে ঘোষিত মূল্য ও করহার বহাল থাকবে।

>> কেবল টিভি নেটওয়ার্কের ডিজিটাল অ্যাড্রেসেবল সেট-টপ বক্স আমদানির শুল্কের বিষয়টি নিয়ে পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী।

>> গুঁড়া মসলা জাতীয় মরিচ, হলুদ, ধনিয়া এগুলোর ট্যারিফ মূল্য বহাল রেখে ভ্যাটের হার নির্ধারণের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী।

‘এটিই শ্রেষ্ঠতম বাজেট’

বাজেট প্রস্তাবের পরদিন সংবাদ সম্মেলনে

ব্যাপক সমালোচনার পরও আবুল মাল আবদুল মুহিত বুধবারও বলেন, এটিই তার দেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ বাজেট।

“এই বাজেটটি আমার একাদশতম বাজেট এবং আমি বলেছিলাম যে এইটি হবে আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বাজেট।

সুদীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্কের পর বাজেটটিকে নানাভাবে সমৃদ্ধশালী ও জনবান্ধব করে আজকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ও পরামর্শ গ্রহণ করে যেভাবে এইটি প্রস্তাবিত হয়েছে তাতে সত্যিই দাবি করছি যে এইটি একটি অত্যুত্তম বাজেট প্রস্তাব, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম বাজেট।”

সঞ্চয়পত্রের সুদহার পরিবর্তনের যুক্তি

বক্তৃতায় নানা বিষয়ে বলতে গিয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর যুক্তিও দেখান মুহিত।

তিনি বলেন, “অনন্তকালের জন্য সঞ্চয়পত্রের সুদের হার নির্দিষ্ট থাকতে পারে না। সুদের হারের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে, মূল্যস্ফীতি বাড়লে সুদের হার বাড়ে আর মূল্যস্ফীতি কমলে সুদের হার কমে। বিষয়টি তাই আমাদের পুনর্বিবেচনা করতে হবে।”

অর্থমন্ত্রী জানান, সঞ্চয়পত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে সরকারকে। এতে সুদের বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারের ব্যয় ব্যবস্থাপনার উপর একটি বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে।

তবে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার নির্ধারণের কারণে কোনো পেনশনভোগী, নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত কেউ যাতে ‘উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়’ সে বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে বলে জানান মুহিত।

মুহিতের আশাবাদ

২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিষয়ে ‘কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ’ করলেও এটা অর্জন হবে বলে আশাবাদী অর্থমন্ত্রী।

বুধবার প্রধানমন্ত্রীর বাজেট আলোচনার সময় পাশে অর্থমন্ত্রী মুহিত

তিনি বলেন, ২০১৫-১৬ সালে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ০৫ শতাংশের বিপরীতে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ অর্জিত হয়েছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিবিএসের সাময়িক হিসাবে প্রবৃদ্ধি এসেছে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ।

“তার মানে হচ্ছে যে, আমরা বিগত ২ বছর যাবৎ আমাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছি। এ ধারা সামনের দিনগুলোতে অব্যাহত থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি।”

তিনি প্রবৃদ্ধি নির্ধারক সূচকগুলোর গতিবিধির উপর আলোকপাত করেন বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের এপ্রিল নাগাদ আমদানি, রপ্তানি ও ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। রেমিটেন্সও সম্প্রতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উৎপাদন সূচক বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাংক ব্যবস্থায় আমানত ও ঋণের সুদের হার ব্যবধান অব্যাহতভাবে কমছে। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ।

“মূলত দীর্ঘদিন যাবৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকা, নীতি কৌশলগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা ও এগুলোর সুসমন্বিত প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অব্যাহত সরকারি উদ্যোগ ইত্যাদির প্রভাবে ব্যবসায়ী/বিনিয়োগকারীসহ সকল স্তরের জনগণ দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ক্রমেই আশাবাদী হয়ে উঠেছেন যা ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধির পথকে প্রশস্ত করেছে।”

উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি সচল রাখার বিষয়ে বাজেটে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।

পর্যায়ক্রমে শিল্প স্থাপনের বাধাগুলো দূর করতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।