ভোটের জন্য ভ্যাটে ছাড়

নতুন আইন কার্যকর করে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নিয়ে আগামী অর্থবছরের জন্য যে বিশাল ব্যয়ের ফর্দ তৈরি করেছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত; প্রবল বিরোধিতার মুখে তা থেকে পিছু হটতে হল তাকে।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 June 2017, 12:44 PM
Updated : 28 June 2017, 04:52 PM

ব্যবসায়ীদের বিরোধিতা ছিল আগে থেকেই; গত ১ জুন সংসদে বাজেট উপস্থাপনের পর সাধারণ মানুষের উদ্বেগ দেখে প্রথমে সরব হয় বিরোধী দলগুলোও; এরপর সরকারি দলের সদস্যরাও নিজেদের সরকারের অর্থমন্ত্রীর সমালোচনায় নামেন। এমনকি মন্ত্রীরাও যুক্ত হন এই দলে, সংসদে উপস্থাপনের আগে যারা নিজেরাই এই বাজেট অনুমোদন করেছিলেন।

এই সবের মধ্যেও যে কোনোভাবে নতুন ভ্যাট আইন আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকরের বিষয়ে অনড় ছিলেন মুহিত; ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেটে যিনি ভ্যাট থেকেই আয় ধরেছিলেন ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা অর্থাৎ অঙ্কের হিসাবে যা প্রায় এক-চতুর্থাংশ।

কিন্তু বুধবার সংসদে অর্থবিল পাসের আগে বাজেট আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ভ্যাট আইন কার্যকর করা আরও দুই বছর পেছাতে বললে মাথা নোয়াতে হয় টানা নবম বাজেট দেওয়ার রেকর্ডধারী মুহিতকে।

দৃশ্যত ভোটের দেড় বছর আগে জনগণ যাতে বিমুখ না হয়ে যায়, তার জন্যই ভ্যাট থেকে সরকারের এই পিছু হটা। সংসদে এই আইনের কার্যকরের বিরোধিতাকারী আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যদের বক্তব্যই এই মনে করার পেছনে যুক্তি দেখায়।

ভ্যাট আইন এবং ব্যাংক হিসাবে আবগারি শুল্কের বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ বলেছিলেন, “এবারই নির্বাচনমুখী বাজেট করা উচিৎ ছিল। বলা যায়, অর্থমন্ত্রী এবার নির্বাচনবিরোধী বাজেট করেছেন।”

“ভোটারদের উপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করলেন আর তারপর তাদের কাছে ভোট চান। দেশের মানুষ কি এতই পাগল!” বলেছিলেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ।

এই সব কথার পর বুধবার সংসদে বাজেট আলোচনায় সরকার প্রধান শেখ হাসিনা বলেন, ভ্যাট আইন নিয়ে যেহেতু নানা ধরনের কথা হচ্ছে, এটা আগের মতোই থাকবে।

“ব্যবসায়ীরা তাতে সাড়া দিচ্ছেন না। সেভাবেই করে দেবেন, আগামী দুই বছরের জন্য। বর্তমান পদ্ধতিতেই ভ্যাট আদায় বজায় রাখবেন।”

এরপর অর্থমন্ত্রী মুহিত সংসদে বলেন, “আমি মূসক আইনের পূর্ণ কার্যকারিতা পিছিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করছি। আগের ধারাবাহিকতায় কিছু সংশোধন করে ২০১২ সালের আইনই যেভাবে গত চার বছর ধরে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হচ্ছে, ঠিক তেমনিভাবে আমাদের বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।”

আগামী বছরের শেষ ভাগে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের সময় নির্ধারিত। ফলে ভ্যাট আইনটি আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকার আমলে আর কার্যকর হচ্ছে না।

ভ্যাট আইনের বিরোধিতায় ব্যবসায়ীরা (ফাইল ছবি)

সব পণ্য বিক্রির উপর অভিন্ন হারে ১৫ শতাংশ ভ্যাট নিতে ২০১২ সালে আইনটি করেছিল সরকার। ২০১৬ সালের ১ জুলাই তা কার্যকরের পরিকল্পনাও ছিল মুহিতের। কিন্তু ব্যবসায়ীদের প্রবল বিরোধিতার কারণ সেবারও পিছু হটতে হয়েছিল তাকে। তখন বলা হয়েছিল আর এক বছর পরই নতুন আইন কার্যকর হবে।

ভ্যাট আইনের বিরোধিতায় যেসব সংসদ সদস্যরা সরব ছিলেন, তাদের সামনে এই আইন প্রণয়নের ইতিহাসও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “মূসক আইনটি ১৯৯১ সালে করা, ২০০৮ সালে সংশোধনের জন্য খসড়া তৈরি হয়। সবার সঙ্গে মতবিনিময় করেই আইনটি আমরা করে দিই ২০১২ সালে। এখন সবাই ভুলেই গেছে যে আইনটি আমরা পাস করে দিয়েছিলাম।”

উন্নয়নের জন্য কর বাড়ানোর উপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ভ্যাট-ট্যাক্স যাই দিচ্ছি, সব তো দেশের উন্নয়নের কাজেই লাগবে। তা যদি না দিই, তাহলে তো ভিক্ষা চাইতে হবে।”

এবার বিশাল বাজেটের খরচ মেটাতে দুই লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে কর ও শুল্ক হিসেবে আদায়ের পরিকল্পনা নেন মুহিত। এর মধ্যে ভ্যাট থেকে ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা আনার পরিকল্পনা দৃশ্যত বাধাগ্রস্ত হল।

এখন ব্যবসায়ীরা বিক্রির অনুপাতে ভ্যাট দিচ্ছেন না, যা নতুন আইনে দিতে হবে। এখন তারা বাৎসরিক নির্দিষ্ট একটি অঙ্ক ভ্যাট হিসেবে দিচ্ছেন।

নতুন আইনে ভ্যাটের হিসাব বের করা ক্ষুদ্র বিক্রেতাদের জন্য দুষ্কর হবে বলে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো দাবি করে আসছিল।

অন্যদিকে ভোক্তা সংগঠন ক্যাব বলছিল, ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে গেলে বাজারে পণ্যমূল্য বাড়বে এবং তাতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ক্রেতারা।

উন্নয়নের জন্য চাই কর

নির্বাচনের আগে ভ্যাট আইনটি কার্যকর করা স্থগিত করলেও উন্নয়নের জন্য কর দেওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট আমরা দিয়েছি।

সংসদে বাজেট আলোচনায় শেখ হাসিনা

“আমরা কারও কাছে ভিক্ষা চেয়ে চলতে চাই না, অনুদান নিয়ে চলতে চাই না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর মতো করে আমাদের বাজেট প্রণয়ন করে যাচ্ছি।”

এক সময় বাংলাদেশে বাজেট প্রণয়নে বিদেশি অনুদানের উপর নির্ভর করার বিষয়টি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা সেই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসেছি। এখন নিজের অর্থে বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা অর্জন করেছি।”

২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ‍উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে সরকারের চেষ্টার কথা বলেন তিনি।

কর দেওয়ায় জনগণের সাড়ার দিকটি তুলে ধরার বিপরীতে বিদেশ থেকে পুরস্কার নিয়ে এসে কারও কারও কর কমানোর আবেদনের কথাও বলেন শেখ হাসিনা।

“আমাদের দেশের বেশ কিছু খ্যাতিমান মানুষ বিদেশ থেকে কিছু পুরস্কার পেয়েছে, এসে বলেন যে আমার ট্যাক্সটা কমিয়ে দেন।”

এক্ষেত্রে নিজের পাওয়া পুরস্কারের ক্ষেত্রে কখনও কর ফাঁকি না দেওয়ার কথা বলেন শেখ হাসিনা।

“আমি আবারও বলব কর দেওয়া, এখানে ফাঁকি দিতে গেলে নিজেরাই ফাঁকিতে পড়বেন,” অন্যদেরও সতর্ক করেন তিনি।