‘একগুয়েমি বন্ধ করেন, কথা কম বলেন’

আবগারি শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাবসহ বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কথাবার্তায় সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে বলে তার কড়া সমালোচনা করেছেন ক্ষমতাসীন দলের জ্যেষ্ঠ আইনপ্রণেতারা।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 June 2017, 08:49 AM
Updated : 20 June 2017, 09:45 AM

সোমবার জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে বাজেট আলোচনার শুরুতে অর্থমন্ত্রী অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত থাকলেও এক পর্যায়ে উঠে যান।

আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, “অর্থমন্ত্রী বাজেট দিয়েছেন ভালো কথা। কিন্তু জনগণের কষ্ট আওয়ামী লীগ মেনে নিতে পারে না। আবগারি শুল্ক প্রত্যাহার করেন।

“আপনার কিছু কথা বার্তা সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। আপনি কম কথা বলেন। বয়স হয়ে গেছে, কখন কী বলে ফেলেন।”

বাজেটে সমস্যা থাকলে তা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস দিলেও অর্থমন্ত্রীর ভিন্ন সুরের সমালোচনা করেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য।

অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে বিভ্রান্তির উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “আপনি বললেন, একলাখ টাকা যার আছে সে সম্পদশালী। চার হাজার কোটি টাকা কোনো টাকা না বললেন আর একলাখ টাকা টাকা হয়ে গেল!

“আপনি অর্থমন্ত্রী, আপনার কাজ বাজেট পেশ করা। এই সংসদের ৩৫০ জন জনগণের প্রতিনিধি ঠিক করবেন জনগণের কল্যাণে কোনটা থাকবে, থাকবে না। একগুয়েমি সিস্টেম বন্ধ করেন, কথা কম বলেন।”

গত ১ জুন প্রস্তাবিত বাজেট সংসদে দেওয়ার পর ব্যাংক হিসাবে বাড়তি আবগারি শুল্ক নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা সমালোচনা করে আসছেন। সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর ঘোষণা ও ভ্যাটের হার নিয়েও তাদের আপত্তি আছে।

সেলিম বলেন, “আইএমএফ বিশ্ব ব্যাংকের কথা শুনে... কমিয়ে দিলেন। বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুর টাকা ঘুরিয়ে নিয়ে গেল। ভ্যাটের আওতা বাড়ান। সব প্রতিষ্ঠানকে ইসিআর মেশিন দেন, যাতে ভ্যাট দিতে বাধ্য থাকেন। ঢালাওভাবে ভ্যাট বিশ্বে কোথাও নেই।”

আবগারি শুল্ক আগের অবস্থায় রাখার দাবি জানিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, “অর্থমন্ত্রী কী কারণে কার স্বার্থে ব্যাংক হিসাবে আবগারি শুল্ক করেছেন জানা নেই।

“হল-মার্কের চার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির পর অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এ টাকা কিছু নয়। তাহলে কেন সামান্য টাকার জন্য সারা দেশে মানুষের মধ্যে আক্ষেপ ​তৈরি করলেন।”

১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রস্তাবের বিরোধিতা করে সরকারি দলের এই সদস্য বলেন, “অর্থমন্ত্রী ভ্যাট আরোপ করেছেন গণহারে। পৃথিবীর ইতিহাসে এক বছরে ৩০ শতাংশ বাড়তি ভ্যাট আহরণের নজির নেই। এটা যৌক্তিক নয়।”

‘নির্বাচন বিরোধী বাজেট’

হানিফ বলেন, “বাজেট নিয়ে সারা দেশে আলোচনার ঝড় চলছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এটা নির্বাচনী বাজেট নয়। তাহলে মাননীয় অর্থমন্ত্রী কবে নির্বাচনী বাজেট দেবেন?

“আগামী বাজেট কার্যকর হবে জুলাইয়ে। তখন বর্ষা শুরু হবে। সেপ্টেম্বরে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় গেলে, অক্টোবরে নির্বচনের তফসিল। এবারই নির্বাচনমুখী বাজেট করা উচিত ছিল। বলা যায় অর্থমন্ত্রী এবার নির্বাচনবিরোধী বাজেট করেছেন।”

ব্যাংক খাতে লুটপাটের অভিযোগ এনে তিনি বলেন, “বেসিক ব্যাংককে এক হাজার কোটি টাকা মূলধন দেওয়া হচ্ছে। কার টাকা কেন দিচ্ছেন? তারা দুর্নীতির জন্য লুটপাট করবে আর মূলধন দিতে হবে​ আমাদের? প্রয়োজনে এ ব্যাং​কগুলোর বিষয়ে নতুন করে চিন্তা করা হোক। সরকারি টাকা এভাবে লুটপাট করতে দেওয়া যাবে না।”

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য, আদালতের সরকারি কৌঁসুলিদের ভাতা বাড়ানোর দাবি জানান হানিফ।

‘বাজেট দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে’

সাবেক তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বলেন, “সামনে আমাদের নির্বাচন আসছে। জনগণকে বিভ্রান্ত করে দিলে...। আগামী নির্বাচনে আল্লাহ তাকে (অর্থমন্ত্রী) সুযোগ দেবে কি না জানি না। কিন্তু যাদের আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেবে তারা যাতে নির্বাচন করতে পারে সেটা খেয়াল করতে হবে। মানুষকে যদি বিভ্রান্ত করে দেই তাহলে...?”

ব্যাংক হিসাবে বাড়তি আবগারি শুল্ক প্রত্যহারের দাবি করে তিনি বলেন, “এটা মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। সুদ এমনিতেই কম।”

সঞ্চয়পত্রে সুদের হার না কমানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “এটা কমালে ঠিক হবে না। ১০ শতাংশ বাড়ালে খরচ হবে এক হাজার কোটি টাকা। কিন্তু উপকার পাবে লাখ লাখ মানুষ। এটা সিনিয়র সিটিজেনরা পান। তারা কোথাও হাত পাততে পারে না।

“অনেক শ্রেণির মানুষকে ভর্তুকি দেই। ঋণ খেলাপিদের বিশাল লিস্ট দিছেন। কই তাদের তো ধরতে পারেন না। ব্যাংকের টাকা পাচার বন্ধ করতে পারছেন না। আর নিম্ন মধ্যবিত্তের ওপর কর চাপিয়ে দিচ্ছেন। এটার প্রতিবাদ করছি।”

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংসদীয় কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ অর্থমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, “উনি অনেক পরিশ্রম করেছেন। উনার সাথে এনবিআর ও মন্ত্রণালয় পরিশ্রম করেছে। বাজেট বাস্তবায়ন করতে গেলে দক্ষ জনশক্তি থাকা দরকার। খালি কর বাড়ালে হবে না। উপজেলা পর্যায়ে এনবিআরের কর্মকর্তা দেন।

“সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল পূরণের জন্য আমাদের দক্ষ কর্মকর্তা দরকার। প্রায় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রজেক্ট ঠিকমতো করতে পারে না। প্রপোজাল করতে পারে না। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংসদীয় কমিটির মিটিংয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে ডাকি। আপনি বিশ্বাস করবেন না মাননীয় স্পিকার, পরিকল্পনামন্ত্রী সামনে আছে, আমি দেখিয়ে দিয়েছি, এরা টাকা ঠিকমতো খরচ করতে পারে না।”

এসময় বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “বিদ্যুতের উন্নতি হয়েছে ঠিকই, অনেক লাইন হয়েছে। কিন্তু রমজানের সময়, সেহরির সময় আমার এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। ১৪-১৫ বার যদি বিদ্যুৎ যায় তাহলে...। এগুলো ঠিক করার উদ্যোগ নিন।”

পাশে বসে থাকা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খাঁন কামালের উদ্দেশে আবুল কালাম বলেন, “এই যে ইয়াবা, ফেন্সিডিল, শিশু ধর্ষণ যেভাবে হচ্ছে... এগুলোর (বিষয়ে) জোরালোভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনাকে ব্যবস্থা নিতে হবে।

“যৌতুকের কারণে বউকে মেরে ফেলছে। দেশ উন্নত হচ্ছে, কিন্তু সামাজিক অবক্ষয় বাড়ছে। মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে না। যুব সমাজ কীভাবে চলছে? ভ্রষ্টাচার, সামাজিক অবক্ষয়।”