বাজেটের ‘মূসক’ প্রসব

বহু আলোচিত মূসক বা ভ্যাট আইনের নিড়ানি দিয়ে বিশাল বাজেট বাস্তবায়নের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বৃহস্পতিবারের বক্তৃতায়।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 June 2017, 06:13 PM
Updated : 1 June 2017, 07:26 PM

শুধু ভ্যাট আইনের ওপর ভর করে মুহিতের ‘বেস্ট বাজেট’ এর পার পাওয়া কঠিন বলে অনেকে মনে করলেও কার্যত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন সব ধরনের আয় ও মুনাফার ওপর কর এবং শুল্ক আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার উল্লম্ফন ঘটিয়ে প্রত্যাশার পায়ে মাটি দিয়েছেন তিনি।

নির্বাচনের আগের বছরের বাজেটে চাপাচাপি করবেন বলে যে কথা বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী দৃশ্যত সেই চাপে বন্দি করেছেন তিনি মধ্যবিত্তকে।

ভ্যাট আইনের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের চাপে কিছুটা নমনীয়তা দেখালেও রাজস্ব কাঠামো সংস্কার ছাড়াই বিপুল রাজস্ব আদায় বরাবরের মতো এবারও দিশেহারা করে তুলতে পারে মুহিতকে।

সামষ্টিক অর্থনীতিতে গত কয়েক বছরের ধারাবাহিক স্থিতিশীলতা মুহিতের স্বপ্নের সলতে হলেও সাহিত্যের এই কৃতী ছাত্র যেসব অনুমান করেছেন তা নির্ভর করবে অনেক যদি’র উপর।

এর মধ্যে অন্তত দুটি পূর্বাভাসের উপর তার কোনো হাত থাকার সুযোগ নেই।

বাজেট উপস্থাপনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ছবি: পিআইডি

তিনি বলেছেন, বিশ্ব উৎপাদন প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার অব্যাহত থাকবে এবং লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রপ্তানি ও প্রবাস আয় অর্জিত হবে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য তার বাজি মানুষের কর্মোদ্যম এবং কৃষক-শ্রমিকের কর্মস্পৃহা।

বিপুল খরচের বিপরীতে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে এ নামিয়ে আনা এবং সরকারি বিনিয়োগে ভর করে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত করাটা চ্যালেঞ্জ বটে। প্রবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরা দুর্নীতির তিরোধানে সরকারের কার‌্যকর উদ্যোগ যেখানে অদৃশ্যমান সেখানে এই প্রত্যাশা আশাতীত আশাই।

নিম্ন আয়ের মানুষদের পকেটে সরাসরি হাত না দিলেও সরকারের উচ্চাভিলাষী রাজস্ব স্বপ্নের মাসুল গুনতে হতে পারে তাদেরও।

তবে শেখ হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার রক্ষা করা হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের অর্থ বরাদ্দে অর্থপূর্ণ প্রবৃদ্ধি রেখে।

কোন কোন জিনিসের দাম বাড়ছে, কোন কোন জিনিসের কমছে- বাজেটে সে দিকেই মূল আগ্রহ থাকে সাধারণ মানুষের; বৃহস্পতিবার সংসদে অর্থমন্ত্রীর বাজেট উপস্থাপনের সময় রাজধানীর বাংলা মোটরে টেলিভিশনে চোখ এই নাগরিকদের। ছবি: আব্দুল মান্নান

সবচেয়ে বড় বরাদ্দ বরাবরের মতো শিক্ষা খাত পেলেও স্বাস্থ্য খাতে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণে কোনো দিক নির্দেশনা মিলেনি বলে মনে করছেন জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

অগ্রাধিকারমূলক বড় প্রকল্পগুলোতে অর্থ বরাদ্দ অব্যাহত থাকলেও পদ্মা সেতু ছাড়া অন্যগুলোর কোনো দৃশ্যমাণ অগ্রগতি নেই।

আগের বাজেটগুলোর বিপরীতে সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ সদিচ্ছারও প্রকাশ নেই এবারের বাজেটে।

উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিদ্যমান স্থানীয় সরকার কাঠামোকে এর আগের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বাধা বলে মন্তব্য করলেও তা সংস্কারের কোনো কথা এবার বলেননি। এই খাতে বরাদ্দ আনুপাতিক হারে গতবারের মতোই রেখেছেন।

সংক্ষেপে আয়-ব্যয়, বরাদ্দ

জাতীয় নির্বাচনের দেড় বছর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা খরচের পরিকল্পনা মুহিতের। এই খরচের আড়াই লাখ কোটি টাকাই জনগণের দেওয়া কর থেকে ব্যয় করবেন মন্ত্রী। যার মধ্যে লাখ কোটি টাকাই নতুন ভাবে শুরু করা ভ্যাট থেকে আসবে।

সংসদ ভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর শেখ হাসিনার সঙ্গে বেরিয়ে আসছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত; তার হাতের কালো ব্রিফকেসে আগামী অর্থবছরের ব্যয়ের ফর্দ, যা তিনি উপস্থাপন করেন সংসদে। ছবি: পিআইডি

অর্থমন্ত্রীর এই হিসাব-নিকাশকে বেশ ‘বড় চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে দেখছেন গবেষক জায়েদ বখত।

অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটকে সম্প্রসারণমূলক ধারাবাহিক বড় বাজেট অ্যাখা দিয়ে তিনি বলেন, “আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এমন বড় বাজেটের প্রয়োজন আছে। কেননা, বিনিয়োগে যে স্থবিরতা বিরাজ করছে তা কাটানোর জন্য অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করার জন্যই বড় বাজেট প্রয়োজন।”

‘তবে এই বড় বাজেটের চ্যালেঞ্জও বড়’ উল্লেখ করে জায়েদ বখত বলেন, “এবারের বাজেটের মেইন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। বিশেষ করে ভ্যাট থেকে ৯১ হাজার কোটি টাকার বেশি যেটা আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে সেটা পূরণ করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ।”

অর্থমন্ত্রীর আয়-ব্যয়ের হিসেবে ঘাটতি প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রীর আশা দেশজ উৎপাদন বাড়বে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ হারে।

জাতীয় সংসদ ভবনে বৃহস্পতিবার ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে মুহিত ব্যয় করবেন ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার ব্যয় পরিকল্পনা কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকায়। এই হিসেবে বাজেট বাড়ছে ২৬ দশমিক ২০ শতাংশ।

এই যে বিশাল ব্যয় পরিকল্পনা তাতে আয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে বিদেশি অনুদান সাড়ে ৫ হাজার কোটি ধরলে মোট আয় দাঁড়ায় ২ লাখ ৯৩ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা।

এই যে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করবেন অর্থমন্ত্রী, কিন্তু টাকাটা আসবে কোত্থেকে?

দেশের মানুষের দেওয়া কর এবং বিদেশি অনুদান সব মিলে আয় হবে ২ লাখ ৯৩ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। রাজস্বের প্রায় সব ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি আসবে এনবিআর আহরিত কর থেকে।

এনবিআর বহির্ভূত কর ৮ হাজার ৬৬২ কোটি। এখানে যোগ হবে মাদক শুল্ক, যানবাহন কর, ভূমি রাজস্ব এাবং নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প বিক্রির অর্থ। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তি ৩১ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা আসবে সরকারের বিভিন্ন বিনিয়োগের লভ্যাংশ ও মুনাফা, প্রশাসনিক ফি, ভাড়া ও ইজারা, সেতুর টোল ও লেভিসহ বিভিন্ন আয় থেকে। রাজস্ব আয়ের বড় অংশের যোগান আসবে আয়কর, শুল্ক ও মূসক থেকে।

তবে সব কিছু ছাপিয়ে রাজস্ব আয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ১ জুলাই থেকে ভ্যাট আইন কার্যকর করা।

বাজেটের মোট ব্যয়ের মধ্যে বড় দুই খাত উন্নয়ন ব্যয় এবং অনুন্নয়ন ব্যয়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিপিসহ উন্নয়ন ব্যয় আগেই চূড়ান্ত হয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৩ কোটি টাকা। এই অর্থ দিয়েই তৈরী হচ্ছে পদ্মা সেতু, মেট্টো রেল, মাতারবাড়ী তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে টানেল কিংবা রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। আবার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, রাস্তা-ঘাট, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণও হয় এই উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দ থেকে। বরাবরের মতো এবার সবচে গুরুত্ব পেয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং পরিবহন ও যোগাযোগ খাত।

রাস্তা-ঘাট, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের বাইরে সরকার যে ব্যয় করে তাই অনুন্নয়ন ব্যয়। এর বড় অংশ চলে যায় সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, পেনশন পরিশোধ এবং দেশের ভেতর ও বিদেশ থেকে নেয়া ঋণের সুদ পরিশোধে, ভর্তুকি ও প্রণোদনা ব্যয় মেটাতে।

আয় ও ব্যয়ের অংক তো জানা হলো। এখন প্রশ্ন এই দুইয়ের যে ফারাক, সেই ঘাটতি মেটানো হবে কোত্থেকে?

১ লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকার ঘাটতি মেটাতে বরাবরের মতো এবারও অর্থমন্ত্রী ভর করেছেন দেশের ভেতরের ব্যাংক থেকে ধার-কর্জ, বিদেশি ঋণ এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে অর্থ পাওয়ার ওপর।

বাজেট বক্তৃতার একদম শেষে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, যেভাবে ব্যয় পরিকল্পনা করা হয়েছে তাতে ২০২১ সালের আগেই চরম দারিদ্র্যকে বিদায় করতে চান তিনি।

ইংরেজ কবি রবার্ট ফ্রস্টকে উদ্ধৃত করে বলেছেন তিনি, “…..miles to go before I sleep.”