আশাতীত আশাবাদে রাজস্ব চাষ

বাজেটের রাজনৈতিক অর্থনীতির জটিল ধাঁধা ভাঙেন রাজনীতি আর অর্থনীতির বোদ্ধারা; সাধারণ নাগরিকদের কাছে তা কেবলই হিসেবের অঙ্ক, জমা-খরচের যোগ-বিয়োগ।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 May 2017, 04:31 PM
Updated : 1 June 2017, 02:42 AM

রাজধানীর শেওড়াপাড়ার নরসুন্দর সেলিম আহমেদ তাদেরই একজন, বাজেটের আগের দিন বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বললেন, “মোটা চালের কেজিই তো ৫০ টাকা। বাজেটে কি চালের দাম কমবে? শুনছি নতুন ভ্যাটে নাকি সব কিছুর দাম আরও বেড়ে যাবে। আমাদের কী হবে?”

যদিও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের জোর দাবি, “নতুন ভ্যাট আইনের কারণে বাজারে কোনো জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না।”

শুধু তাই নয়, অর্থমন্ত্রী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের কাছে দাবি করলেন, “আমার কোনো বাজেটের পরই বাজারে পণ্যের দাম বাড়েনি। এখন যেটা বেড়েছে সেটা রোজার কারণে, অতি মুনাফার আশায় ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছে।”

নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ ও জীবনযাপনে ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কার মধ্যে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করবেন অর্থমন্ত্রী।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, রাজস্ব আদায়ে ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য চার লাখ কোটি টাকা খরচের রূপরেখা ঠিক করেছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত।

সংস্কারের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় চলতি বছরের কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব প্রবৃদ্ধি অধরা থাকলেও এবার অর্থমন্ত্রীর হাতে আছে ভ্যাট আইনের মোক্ষম অস্ত্র।

সম্ভাব্য মোট খরচের দুই লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় থেকে আসবে বলে প্রত্যাশা টানা নবম বাজেট দিতে যাওয়া একমাত্র বাংলাদেশি মন্ত্রীর।

খরচের বাকি এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা ঘাটতিই থেকে যাচ্ছে; হিসাবে যা জিডিপির ৫ শতাংশেরও বেশি। বিশাল এই ঘাটতি পূরণে অশতিপর অর্থমন্ত্রীর সহায় অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ঋণ।

নিজেকে আশাতীত আশাবাদী বলে পরিচয়দানকারী সাহিত্যের একদা নামজাদা এই ছাত্র বলছেন, নিজের সেরা বাজেটটিই এবার দিতে যাচ্ছেন তিনি। আগামীবার নির্বাচনের বছরের বাজেটে খুব একটা সৃষ্টিশীলতার সুযোগ থাকবে না বলে এবারই নিজের ধীশক্তির শেষ পরীক্ষায় মুহিত। আগামী মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলেও মন্ত্রিত্বে থাকবেন না সাবেক ঝানু এই আমলা।

শেখ হাসিনা সরকারের ২০০৯-১০ অর্থবছরের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট দেন মুহিত। সেই বাজেটের আকার ছিল ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ১ লাখ কোটির নিচ থেকে বাজেটের আকার এখন ৪ লাখ কোটির টাকারও বেশি।

বড় বাজেট হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না- এমন গুরুতর সমালোচনায় অনেকের সায় থাকলেও তা মানতে চান না অর্থমন্ত্রী। এর পক্ষে তার উদাহরণ, এবারের এডিপির আকার অক্ষত রাখা। বাজেট তৈরির কাজ শেষ করে নিজেকে দারুণ তৃপ্ত মনে করছেন তিনি।

“ভালোয় ভালোয় আরেকটি বছর, তারপর অবসর…।”

সামরিক সরকারের দুটিসহ এবারেরটি নিয়ে ১১ বারের মতো বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন নতুন সহস্রাব্দে আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক রূপকল্পক মুহিত।

সমাচার ভ্যাট

ভ্যাট (মূসক) হারে সন্তুষ্ট করতে না পারলেও অনেক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ছাড় দিয়ে ব্যবসায়ীদের খুশি করার চেষ্টা করছে সরকার।

বাজেট ঘোষণার ঠিক আগ মুহূর্তে ভ্যাট অব্যাহতির তালিকা বড় করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। নতুন করে দুইশর বেশি পণ্য ও সেবা ভ্যাটমুক্ত হচ্ছে।

নতুন আইনে বিদ্যমান ১৯০০ ভ্যাটমুক্ত পণ্য তালিকায় আরও দুইশ’ পণ্য ও সেবা যোগ হচ্ছে। ইতোমধ্যে সেই তালিকা চূড়ান্ত করেছে বলে এনবিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

কোন কোন পণ্য ভ্যাটছাড় পাচ্ছে সেদিকে সবাই তাকিয়ে থাকবে বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত।

ভ্যাট খাতে চলতি বছরের চেয়ে আগামী বছরে (৮৮ হাজার কোটি টাকা) ৩৫ শতাংশ বেশি আদায় করাই এবারের লক্ষ্য। চলতি অর্থবছরে ভ্যাট খাতে সংশোধিত লক্ষ্য ঠিক করা আছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এরপর আয়কর খাত থেকে ৮৭ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে হবে। আর শুল্ক খাতে সবচেয়ে কম, ৭৩ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য রাখা হচ্ছে।

নতুন ভ্যাট আইনে যা থাকছে

অভ্যন্তরীণ শিল্পের সুরক্ষায় বিদ্যমান সম্পূরক শুল্কের তালিকাও বহাল থাকছে। তাই নতুন ভ্যাট আইনে ১৭০টি পণ্য ও সেবায় সম্পূরক শুল্ক থাকার কথা। এর পরিবর্তে বিদ্যমান সম্পূরক শুল্কের তালিকার ১৪০০ পণ্য ও সেবার ওপরেই সম্পূরক শুল্ক রাখা হচ্ছে।

নতুন করে যেসব পণ্য ও সেবা ভ্যাট অব্যাহতির তালিকায় আসছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো হালকা প্রকৌশল খাতের মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর ও শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) সংযোজন শিল্প, ভোজ্যতেল, সফটওয়্যার শিল্প, বাস ট্রেন লঞ্চের টিকিট, সব ধরনের প্রশিক্ষণ সেবা, হার্টের রোগীর রিং, ডায়ালাইসিসের কৃত্রিম কিডনি ইত্যাদি।

নতুন আইনে মৌলিক খাদ্যপণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, গণপরিবহন, চিকিৎসা ও শিক্ষা, কৃষি, মৎস্যসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় খাতের ১ হাজার ৮৭৪টি পণ্য ও সেবায় ভ্যাট অব্যাহতি আছে। শেষ মুহূর্তে এই তালিকায় আরও পণ্য ও সেবা যুক্ত হচ্ছে।

পরিবর্তন আসছে আয়করেও

এবার আয়করেও বেশ কিছু বড় পরিবর্তন আসছে। ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে পৌনে তিন লাখ টাকা করা হচ্ছে। বর্তমানে সোয়া দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে মোট আয়করের ১০ শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়। বাজেটে সারচার্জের আওতায় সীমা আড়াই কোটি টাকা করা হতে পারে।

এছাড়া তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য আগামী বাজেট সুখকর নাও হতে পারে। বর্তমানে এই খাতে উৎসে কর দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হতে পারে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটের আকার প্রস্তাব করা হচ্ছে চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) এক লাখ ৫৩ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা আগেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বিদায়ী বাজেটের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টায় কালো ব্রিফকেস হাতে সংসদে প্রবেশ করবেন অর্থমন্ত্রী।

ব্রিফকেসের ভেতরে এনবিআর, নন-এনবিআর মিলে মোট রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা আছে দুই লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে দুই লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা।

বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হতে পারে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির আশা নিয়ে আগামী বাজেটেও বেশি ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। চলতি বছরে মূল বাজেটের আকার ছিল তিন লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয় তিন লাখ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা।