সঞ্চয়পত্র বিক্রি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই সরকারকে এ ঋণ বহন করতে হচ্ছে; গুণতে হচ্ছে সুদ। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে বলে হুঁশিয়ার করেছেন অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত।
সরকার চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ১২ মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল। কিন্তু জুলাই-মার্চ সময়েই ৩৭ হাজার ৬৪৮ কোটি ৪২ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর।
সঞ্চয়পত্র বিক্রির এই উল্লম্ফনে উদ্বেগ রয়েছে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিক্রি বাড়ায় সঞ্চয়পত্র খাতে আমাদের সুদ পরিশোধের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার কমার কারণেই এর বিক্রি বাড়ছে। তবে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ায় আমাদের (সরকার) এখন ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নিতে হচ্ছে না।”
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
বিআইডিএস এর গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ব্যাংকে আমানতের সুদের হার ক্রমাগত কমতে থাকায় সাধারণ মানুষ তাদের সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগের জন্য সঞ্চয়পত্র ছাড়া আর কোনো লাভজনক বিকল্প পাচ্ছে না।
“ফলে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। এতে সরকারের ঋণের বোঝা আর সুদ বাড়ছে, সরকারের রাজস্ব বাজেটের ওপর চাপ পড়ছে।”
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) ৩৭ হাজার ৬৪৮ কোটি ৪২ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে।
গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা।
এ হিসাবে এই নয় মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি বেড়েছে ৬৩ শতাংশের মত।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ মার্চ মাসে ৪ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে হয়েছিল ৪ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা।
ডিসেম্বরে বিক্রি হয় ৩ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। নভেম্বরে বিক্রি হয় ৪ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা।
জানুয়ারিতে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৪২০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। একক মাস হিসেবে যা ছিল রেকর্ড।
চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস জুলাই, অগাস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে বিক্রির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩ হাজার ৪৯৮ কোটি ৩৭ লাখ, ৪ হাজার ২৯৭ কোটি ২১ লাখ, ৩ হাজার ৮৫৪ কোটি ৫০ লাখ এবং ৪ হাজার ২৬৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, পুঁজিবাজারে কিছুটা চাঙ্গাভাব ফিরে আসার পর অনেকেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করায় ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গিয়েছিল।
কিন্তু পুঁজিবাজারে আবার মন্দাভাব ফিরে আসায় ফের সবাই সঞ্চয়পত্র কিনছে।
বিনিয়োগে মন্দার কারণে বেশ কিছুদিন ধরেই ব্যাংকগুলোতে বিপুল অংকের অর্থ পড়ে আছে, যাকে ‘অলস অর্থ’ বলা হচ্ছে। ওই অর্থ খাটাতে না পেরে আমানতের সুদ হার কমিয়ে চলেছে ব্যাংকগুলো।
স্থায়ী আমানতের বিপরীতে বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গড়ে ৬ থেকে ৭ শতাংশ হারে সুদ দিচ্ছে, যা সঞ্চয়পত্রের সুদের তুলনায় অনেক কম।
২০১৫ সালের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ গড়ে ২ শতাংশ হারে কমানোর পরও ১১ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পাওয়া যায়।
জায়েদ বখত মনে করছেন, সঞ্চয়পত্র থেকে বিপুল ঋণের চাপে সরকার বাজেট ব্যবস্থাপনায় যে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে, তা এড়ানোর পথ ‘একটাই’।
“সুদের হার কমাতে হবে। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের ‘পেনশন’ এবং মহিলাদের জন্য ‘পরিবার’ সঞ্চয়পত্র ছাড়া অন্য সব সঞ্চয়পত্রের সুদের হার দ্রুত কমাতে হবে,” বলেন তিনি।
অবশ্য সুদ হার কমিয়েও বিক্রির প্রবণতা সরকার কমাতে পারেনি। আগে পাঁচ বছর মেয়াদী এক লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনলে মাসে এক হাজার ৭০ টাকা মুনাফা পাওয়া যেত। ২০১৫ সালের মে মাসে সুদ হার কমানোর পর পাওয়া যাচ্ছে ৯১২ টাকা।
তারপরও সবচেয়ে ‘নিরাপদ’ এ খাতে বিনিয়োগ কমেনি; উল্টো বাড়ছে। অন্য সব সঞ্চয়পত্রের চিত্রও মোটামুটি এক।
গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মূল বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। সুদের হার কমানোর পরও বিক্রি না কমায় সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়। অর্থবছর শেষে দেখা যায়, সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ৩৩ হাজার ৬৮৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা ধার হয়েছে।